Take a fresh look at your lifestyle.

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড

মার্কিন কবি ও সাংবাদিক অ্যালেন গিন্সবাগের মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে একাত্তর আর যশোর রোড। কবিতাকে গানের ফ্রেমে বন্দী করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-কে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বলা যায় কবিতা ও এই গান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে বাঙালির কাছে।

0

ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল:

‘শত শত মুখ হায় একাত্তর
যশোর রোড যে কত কথা বলে,
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে
পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে’
মার্কিন কবি ও সাংবাদিক অ্যালেন গিন্সবাগের মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে একাত্তর আর যশোর রোড। কবিতাকে গানের ফ্রেমে বন্দী করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-কে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছেন। বলা যায় কবিতা ও এই গান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে বাঙালির কাছে। কবিতায় প্রতিবিম্বিত হয়েছে একাত্তরের দুর্বিসহ দিনের কথা :
‘লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে
লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক
লক্ষ জননী পাগলের প্রায়।
রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু
পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ
দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে।
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর
এত শুধু মানুষের মুখ
যুদ্ধ-মৃত্যু তবুও স্বপ্ন
ফসলের মাঠ ফেলে আসা সুখ।’
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মার্কিন এ কবি ভারতের শরনার্থী শিবিরে বাঙালিদের দুর্বিসহ জীবনকে দেখে আবেগময়ী ভাষায় কবিতায় তুলে ধরেন মুক্তি সংগ্রামের রুপকে। শুধু তাই নয়। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিউইয়র্কে ফিরে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর সেইন্ট জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনিরা’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেন। সেখানে কবির নিজের কন্ঠে কবিতা পাঠ সবার অন্তরকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় কবিতাটি গানে সুরারোপিত করে বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন গিন্সবার্গ। পরবর্তীতে মৌসুমী ভৌমিকের কন্ঠে গাওয়া গানটি যেকোনো বাঙালির হৃদয়কে স্পর্শ করে।
কিন্তু এই যে কবিতা, এই যে সুর তার পিছনে কী এমন ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে যশোর রোডের? মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর যশোরের বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ উপপ্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম মেলে ধরেন স্মৃতির ঝাঁপি : ‘২৫ মার্চের পর থেকে যশোর ক্যন্টনমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানি আর্মিরা যশোর শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে থাকে। রাস্তার ধারের পথচারি ও ঘুমন্ত অতি সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করতে থাকে। পাকহানাদার বাহিনীর এরকম আক্রমনে মানুষ ছোট ছোট দলে প্রথমে চৌগাছার বয়রা, মাসিলা ও বর্ণি সীমান্ত দিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে যেতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ চৌগাছার পাশাপাশি বেনাপোল সীমান্ত দিয়েও ভারতে যেতে থাকে।’ একটা সময় বেনাপোলের ওপারে যশোর রোড ধরে বনগাঁ থেকে চাপাবাড়িয়া, টালিখোলা ছাত্র-যুব শরণার্থী শিবিরে ভরে ওঠে। মহাকুমা শহর বনগাঁ ও কলকাতা অভিমুখি ছোট-বড় শহরগুলো শরণার্থীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারতীয়রাও নিজেদের ভালোবাসার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ায়। যশোর রোডের চারপাশে ভারতের নানা প্রান্তের মানুষ ছুটে আসেন সহযোগিতার হাত নিয়ে। তাদের কেউ ট্রেনে পেট্রাপোলমুখি, কেউবা যশোর রোড ধরে শরণার্থী ক্যাম্পে ছুটে আসেন।’
তার কথায় জানা গেল এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ অংশে পাকবাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে সরাসরি যশোর রোড ধরে কলকাতা যাওয়াটা সহজ ছিল না। এজন্য সাধারণ মানুষ যশোর রোডের পাশের গ্রামের রাস্তা ধরে কলকাতা পৌঁছানোর পন্থা বেছে নেন। নভেম্বরের শেষদিকে অথবা ডিসেম্বরের প্রথমদিকে যশোর রোডের ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের ওপর নির্মিত ব্রিজটি পাকসেনারা উড়িয়ে দেয়। এর প্রধান কারণই ছিল যশোর রোড হয়ে কলকাতার সাথে ভারতের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া। ২ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করে। এসময় মিত্রবাহিনী গঠন হলে ভারত থেকে সৈন্যরা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য প্রথমে অপেক্ষাকৃত স্বল্প দূরত্ব ও সড়ক যোগাযোগের তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য চৌগাছার সীমান্ত পথ বেছে নেন। যশোর ক্যান্টনমেন্টের অবস্থান চৌগাছা সীমান্তের কাছে থাকাও এ পথকে বেছে নেয়ার বড় একটি কারণ। এখানকার ভয়ঙ্কর ট্রাঙ্ক যুদ্ধ ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রাঙ্ক যুদ্ধ বলে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। চৌগাছার যুদ্ধ পাকিস্তানিদের বিপর্যয় চূড়ান্ত রুপ নিলে তারা যশোর শহর হয়ে খুলনার দিকে পালাতে শুরু করে।
চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে প্রথমে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করলেও সে পথটি যোগাযোগের জন্য খুব মসৃণ ছিল না। এজন্য সেই যশোর রোডকেই প্রধান সড়কে পরিণত করতে হয়। ভারতীয় পদাতিক ও আর্টিলারি বাহিনীর প্রধান প্রবেশপথই হয়ে ওঠে যশোর রোড। এজন্য ঝিকরগাছার বিধ্বস্ত ব্রিজের নিচে কপোতাক্ষ নদের ওপর তৈরি করা হয় বোটব্রিজ। সাধারণত সেনাবাহিনী যুদ্ধকালীন সময়ে নদী পারাপারে হাওয়াভর্তি নৌকা সাজিয়ে এ বোটব্রিজ তৈরি করে। এ ব্রিজ দিয়ে গোলাবারুদবাহী সামরিক যান নির্বিঘ্নে পার হতে পারে।
৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হলে ঐতিহাসিক আরেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ওঠে যশোর। ১১ ডিসেম্বর যশোর শহরের টাউন হল ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ নেতৃবৃন্দ এই জনসভায় ভাষণ দেন। তারা ওইদিনই আবার কলকাতা ফিরে যান। তাদের আসা-যাওয়ার পথেরও সাক্ষী সেই ঐতিহাসিক যশোর রোড।
শুধু তাদের আসা-যাওয়ার সাক্ষী নয়। এই রোড লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর আসা-যাওয়ার সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে। এই রোড বিজয়ী বাঙালির ঘরে ফিরে আসার সাক্ষী। এই রোড সম্ভমহারা নারী, সন্তানহারা পিতার বেদনার ইতিহাসের পথে অশ্রভরা চোখের পানিতে স্নাত হয়ে রয়েছে। এই রোড আমাদের মহান ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দ্বারের অভিধা  গৌরবদীপ্ত।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষের ভারতে আশ্রয়ে যাবার প্রধান পথটি কিভাবে সৃষ্টি হলো? ইতিহাস বলছে সেটা নিয়েও রয়েছে কিংবদন্তি। ১৮৪২ সালে তৎকালীন স্থানীয় জমিদার কালী পোদ্দারের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় ‘যশোর রোড’। জমিদার মায়ের গঙ্গা স্নানে যাওয়ার সুবিধার জন্যই সড়কটি নির্মাণ করেন। সেটা নিয়ে রয়েছে গল্প : জমিদার কালী পোদ্দারের মা গঙ্গা স্নানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে বজরায় ওঠতে চাইলে মাঝি তাতে বাধ সাজেন। বলেন, ‘তোমার ছেলে কৃপণ জমিদার। তোমাকে নৌকায় নিলে কড়ি পাওয়া যাবে না।’ মা বাড়ি ফিরে ছেলেকে একথা জানালে কালী পোদ্দারের সম্মানে লাগে। তিনি ব্রত নেন সড়ক নির্মাণের। ১৮৪০ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। হাজার হাজার শ্রমিক রাতদিন কাজ করে ১৮৪২ সালে শেষ করেন। ব্যয় হয়েছিল ২ লাখ ৫৮ হাজার কড়ি। শুধু রাস্তা নির্মাণই না। গঙ্গা স্নানে মা যেন গাছের ছায়ায় যেতে পারেন সেজন্য রাস্তার দুইধারে জমিদার কালীবাবু বিদেশ থেকে অতিবর্ধনশীল রেইন্ট্রি গাছের চারা এনে লাগান। সেই গাছ আজও ‘যশোর রোড’ নামের ইতিহাসখ্যাত যশোর-বেনাপোল রোডকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। যশোর থেকে কলকাতা কালীবাবুর এই রাস্তার নাম ‘যশোর রোড’। ইতিহাস বলছে আরেক কথা : শুধু যশোর বেনাপোল রোড কিংবা কলকাতা অবধি নয়; খুলনা শহর পর্যন্ত ব্যাপ্ত যশোর রোড। এর দৈর্ঘ্য খুলনা মহানগরের লোয়ার যশোর রোড থেকে কলকাতার শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৯০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথের বাংলাদেশ অংশে আমরা সবখান থেকেই ‘যশোর রোড’কে বিদায় জানিয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভারত তার অংশের বাঁকে বাঁকে আজও ‘যশোর রোড’কে খোদাই করে ইতিহাসের অংশে রয়ে গেছে।

লেখক: ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক, যশোর অফিস

Leave A Reply

Your email address will not be published.