Take a fresh look at your lifestyle.

আমার মহালয়া যেভাবে সার্বজনীন হয়ে ওঠে

0

বাবলু ভট্টাচার্য : দুর্গা পূজা কবে শুরু হবে সেটা নিয়ে আমার যতটানা মাথাব্যাথা ছিল তার চেয়ে বেশি হিসেব করতাম কোন ভোরে মহালয়াটি হবে। সে জন্য আমাদের কিছু প্রস্তুতি ছিল।
প্রস্তুতি শুরু হতো আমাদের দূর সম্পর্কের ননী মাসির তরফ থেকে। তিনি ভাদ্র মাসের শেষের দিকে দুটো পাকা তাল নিয়ে হাজির হতেন আমার মামার বাড়ি। এসে আমার দিদিমাকে শুধাতেন বাসুর বাবা কহন ফেরবে ইস্কুল থে?
দাদু ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত। সে পর্যন্ত গোবের মা অর্থাৎ ননী মাসি দিদিমার রান্না ঘরের বারান্দায় বসে বক বক করত। মাঝে মাঝে পান তামাক মুখে দিত। দুটো ডাল-ভাত খেত। তারপর দাদু ফিরলে তাগিদ দিয়ে বলত, ময়ালয়াডা কিন্ত শুনতি দিও দাদাঠাকুর। রেডিও চালাতি আবার ভুলে যাওনা।
দাদু ভুলতেন না। মহালয়া শুরুর আগে থেকেই তিনি রেডিওটা কাউকে ধরতে দিতেন না। কেউ ধরলে যদি নষ্ট হয়ে যায়! এই ব্যাপারে আমার দাদু বেশ সতর্ক থাকেন। রেডিওর উপর চাপ কমাতে তিনি বাইরে থেকে আকাশবানীর অনুষ্ঠান শুনে আসতেন। আর মামা কাজ থেকে ফিরে নিয়মিত রেডিওর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করত। কখনো একটু জোরে— কখনো একটু আস্তে করে ভলিউম বাড়িয়ে কমিয়ে রেডিওর শব্দ যন্ত্র পরিক্ষা করত। পিছনের স্ক্রু খুলে ঝাড়া-মোছা করত। কখনো হাজিরহাটের বাজারে পরেশ মিস্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে কিনা চেক করিয়ে আনত। কোনো ভাবেই যেন মহালয়ার ভোরে রেডিওটা বিগড়ে না যায়। মহালয়ার আগের দিন দিদা নিরামিষ রান্না করতেন। আর করা হতো নারকেলের নাড়ু। কিছু পিঠে। আর হাড়ি ভরে হতো লক্ষ্মীবিলাস ধানের পান্তা ভাত। সাত সকালে সেই পান্তা ভাত খাওয়া হতো নারকেল কোরা আরা গন্ধ লেবুরপাতা সহযোগে।

ননী মাসি বিকেলেই চলে আসত। হাজিরহাট থেকে আসত কর্ণ মামা। সঙ্গে নাতিপুতি। সারা রাত না ঘুমিয়ে তারা রাত জেগে বিজয় সরকারের বিচ্ছেদি গান করত। কর্ণমামা আনতো কলাপাতায় তালক্ষীর আর তালের পিঠা। সুন্দলী থেকে শরতদাদু সন্ধ্যার আগেই এসেছে খই মুড়কি নিয়ে। জয়াদিদি এর মধ্যে রওনা হয়েছে—আসতে আসতে রাত গড়িয়ে যাবে। নিয়ে আসবে ঘরে পাতা দই।

আমাদের উঠোনে এর মধ্যেই পশ্চিমপাড়া, নাথপাড়া, বাহিরডাঙা থেকে লোকজন এসে গেছে। পাশের বাড়ির গোপাল মামার পালান থেকে খড় এনে তারা সবাই বসেছে।

দাদু জানেন আকাশবানীর বিশেষ অধিবেশন শুরু হবে ভোর রাতে। তার আগেই ভল্যুম নেড়ে চেড়ে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন দাদু। ননীমাসি খন খনে গলায় বলছে, অ দাদা ঠাকুর, মলয়া দিতি কিন্তু ভুলে যায়ে না। সারা বছর ধরে দিন গুনতিছি। মা দুজ্ঞা আসবে। সিডা না শুনে মরতিও পাত্তিছিনে।

আকাশবানী। দাদু বলে উঠছেন— চুপ চুপ। মহালয়া শুরু হচ্ছে। আমজাদ দাদু ফজরের নামাজ সেরে এসে বলছেন, সাউন্ডডা এট্টু বাড়ায়ে দাও। বুড়ো হইছি। কানে কম শুনি।

এর মধ্যে ঘোষকের ঘোষণা ভেসে আসে–
“শুরু হচ্ছে মহিষাসুরমর্দিনী। রচনা : বাণীকুমার। সুর ও সংযোজনা : পংকজ কুমার মল্লিক। চণ্ডী ভাষ্য পাঠ : বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ আমল থেকে।”

বহু বছর কেটে গেছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বুড়ো হননি। আকাশবানীতে প্রতি বছর মহালয়া করার জন্য তাকে বুড়ো হতে নেই। সবার কান খাড়া হয়ে গেছে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চণ্ডীপাঠ শুরু করেছেন। ননী মাসি চণ্ডীর সংস্কৃত উচ্চারণ কিছুই বুজতে না পেরেও কপালে হাত ঠেঁকিয়ে প্রণাম করছেন মা দূর্গার উদ্দেশ্যে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর সেই সামান্য নাকি কণ্ঠে, অসামান্য উদাত্ত গলায় বলছেন— ‘যা দেবী সর্ব ভূতেষু মাতৃ রুপেণ সংস্থিতা।’

ঢেঊয়ের মতো কখনো তাঁর গলা উপরে উঠছে। কখনো মধ্যে নামছে। কখনো নিচু হয়ে আবার কান্নার মতো করে, ব্যাকুল হয়ে, কখনো আবদার করে, কখনও রুদ্র হয়ে তার নিজের মাকে ডাকছেন।

তার ফাঁকে ফাঁকে গান গেয়ে উঠছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত, মানবেন্দ্র, মান্না দে, পংকজ মল্লিক, সন্ধ্যা, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী…।

মলিনাদিদি চণ্ডীর গল্পটা বোঝেন না। বুঝতেও চান না এই সব শাস্ত্র-কথা। তিনি দেখতে পাচ্ছেন— দুর্গা নামের এক মা তার ছেলেপুলে নিয়ে অনেকদিন পরে বাপের বাড়ী আসছেন। সঙ্গে আসছে প্যাক প্যাক হাঁস, একটা ময়ুর পক্ষী, ভুতুম পেঁচা, গরু মহিষও হেলে দুলে আসছে। বনের বাঘ মামা বয়না ধরেছে সেও মামাবাড়ি আসবে। ঘরের ইঁদুরটা কোন ফাঁকে সবার আগে আগে দৌড়ে এসেছে কেউ টের পায়নি।

মা দুর্গা কাউকেই ছেড়ে আসবেন না। সবাইকে নিয়েই আসবেন তার বাপের বাড়িতে। অমৃত জ্ঞানে বাপের বাড়ীর খুদ কুড়ো খাবেন। এর চেয়ে আর কী সুখ এ জীবনে!

ধীরে ধীরে সকাল হচ্ছে। পূব আকাশ রাঙা হচ্ছে। হাওয়ায় জলের উপর দুলছে পদ্মফুল। ভেসে আসছে টগর আর শিউলির গন্ধ।

এর মধ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে চণ্ডীর স্তত্র পল্লবিত হয়ে আমাদের ভাঙা রেডিও থেকে বারান্দা— বারান্দা থেকে উঠোন— উঠোন থেকে মাঠ ঘাট ফসলের ক্ষেত হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে মহাশূন্যে।

ননী মাসি কান্নাজড়িত কন্ঠে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করতে করতে বলছেন– দুজ্ঞা দুজ্ঞা।

আমরা এখন দই দিয়ে খই মুড়ি খাচ্ছি। পিঠে খাচ্ছি। নারকেলের নাড়ু খাচ্ছি।

একটু দূরে পুকুর পাড়ে দুলছে কাশ ফুল।

দাদু মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছেন— মধুর তোমার শেষ নাহি যে পাই।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.