Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ বেগম আখতার সমুদ্র-সমান-বেদনার-জীবনে

0

বাবলু ভট্টাচার্য: আত্মমগ্ন-গানের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ ও আনন্দ খুঁজে পেতেন বিবি অথবা আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি; সবার কাছে চেনা বেগম আখতার; যার অন্যতম উপাধি ‘মালেকা-ই-গজল’। তাঁর বাবা ছিলেন অভিজাত সৈয়দ পরিবারের মানুষ। সেই ভদ্রলোকের তৃতীয় স্ত্রী মুশতারি বেগমের যমজ দুই মেয়ে। জোহরা এবং বিবি। পরবর্তী কালে সম্পত্তিজনিত কারণে মুশতারির স্বামী তাঁর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। ইতিমধ্যে মারা যায় এক মেয়ে, জোহরা। জীবন সংগ্রামে একা মুশতারি নানা বাধা-বিপর্যয় পেরিয়ে তাঁর আদরের বিবিকে বড় করে তুলছিলেন। এই বিবি-ই পরবর্তী কালে হয়ে উঠবেন ‘মালিকা-এ-গজল’ বেগম আখতার। মুশতারি মেয়ে বিবিকে নিয়ে গয়াতে তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেন।

বিখ্যাত উস্তাদ জামির খাঁ-র কাছে সেখানে বিবি তালিম নেওয়া শুরু করে। এমনই এক সময় পটনায় বন্যা দুর্গতদের সাহায্যার্থে একটি বড় সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠানে মুশতারি অনেক কাকুতিমিনতি করে বিবির গান গাওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনুষ্ঠানে বছর দশেকের বিবির গান শুনে একটি রেকর্ড কোম্পানি তার গান রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। রেকর্ড হয়। কিন্তু, আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি-র সেই প্রথম রেকর্ড বাজারে চলল না। হতাশ মুশতারি এর পর মেয়েকে নিয়ে গেলেন এক পীরের কাছে। সব দেখেশুনে সেই পীর নাকি বলেছিলেন- ‘এক দিন এই মেয়ের সামনে সারা পৃথিবী মাথা নত করবে।’ তিনি বিবিকে গানের খাতাটা খুলতে বলেন। তার পর চোখ বন্ধ করে হাত রাখেন খাতার একটি পাতায়। সে পাতাতেই ছিল ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো’ গানটি। আশ্চর্যের কথা, সেই গান যখন রেকর্ড হয়ে বেরোল, বিবিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র তেরো বছর বয়সে সেই গান তাকে এনে দিয়েছিল ভারত জোড়া খ্যাতি। এরপর বিবি অর্থাৎ আখতারি এলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতায়। পাতিয়ালার ওস্তাদ আতা মুহম্মদ খানের কাছে শুরু হল তালিম। প্রথম দিকে বিবির গান রেকর্ড করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এক বাঙালি সঙ্গীতপ্রেমী, মেগাফোন কোম্পানির কর্ণধার জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ। জিতেনবাবুর জহুরির চোখ আখতারিকে চিনতে ভুল করেনি। চোদ্দ বছর বয়সে আখতারি যোগ দিলেন থিয়েটারে। সেখানেও নিজের অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দেন। এর পরেই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য বম্বে থেকে ডাক আসে। পাশাপাশি আসতে থাকে বিভিন্ন রাজপরিবারে সঙ্গীতের মেহফিলে গান গাইবার অনুরোধ। ‘নলদময়ন্তী’ ছবিতে অভিনয়ের পরে ‘রোটি’তে তিনি অভিনয় করেন। ছবিতে অভিনয়ের আমন্ত্রণের সংখ্যা এর পর যায় বেড়ে। কিন্তু বম্বের জীবনযাত্রা আখতারির না-পসন্দ। তাই তিনি ফিরে এলেন লখনউতে। সেখানেই বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় বসত গানের মেহফিল। এভাবেই নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছিল আখতারির জীবন। আচমকাই তাঁর সঙ্গে দেখা হল পেশায় ব্যারিস্টার কাবুলির নবাব ইশতিয়াক আহমেদ আব্বাসির। ঘটনাচক্রে পরে তাঁর সঙ্গেই বিবাহ হয় আখতারির। বিয়ের পর তিনি পেলেন শিক্ষিত-সুপুরুষ স্বামীর ভালবাসা। অর্থ। প্রতিপত্তি। হিরে-জহরত সব কিছুই। শুধু জীবন থেকে বিদায় নিল গান! কেননা, বিবাহে আব্বাসি সাহেবের শর্তই ছিল, আখতারিকে গান ছাড়তে হবে। সংসার জীবনে একাধিক বার গর্ভবতী হয়েও জন্ম দিয়েছেন মৃত সন্তান। জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটাই হারিয়ে ফেললেন আখতারি। চিকিৎসক এলেন। পরামর্শ দিলেন, এমন কিছু করার প্রয়োজন যাতে আখতারি ভাল থাকেন। ‘শূন্য জীবনে’ নতুন করে আবার শুরু হল গান। গান গাওয়ার পাশাপাশি আখতারি এ
বার গান শেখাতেও শুরু করেন। আখতারি গান গাইবেন শুনে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে রেকর্ড করার প্রস্তাব দিল। তবে আর আখতারি বাঈ ফৈজাবাদি নয়! জন্ম হল এক নতুন শিল্পীর বেগম আখতার। সেই নামেই প্রকাশিত হল দু’টি বিখ্যাত গান। ‘কোয়েলিয়া মত কর পুকার’ এবং ‘সঁইয়া ছোড় দে’। শুরু হল বেগমের নতুন জীবন।
প্রসঙ্গত, কলকাতা ও বাঙালি সমাজের সঙ্গে আখতারির অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বহু দিনের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকে আশ্রয় করে সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর সেই গানের মায়াবি মাদকতায় আজও আচ্ছন্ন সঙ্গীত রসিকেরা। সেই সঙ্গেই চিরস্মরণীয় দুর্গাবাঈর চরিত্রে বেগম আখতার। তাঁকে দিয়ে বাংলা গান গাওয়ানোর সেই সব ঘটনা আজ ইতিহাস। বাঙালির হৃদয়ে ‘জোছনা করেছে আড়ি’, ‘পিয়া
ভোলো অভিমান’, ‘কোয়েলিয়া গান থামা’ ইত্যাদি গান আজও নবীন। ‘আই মোহাব্বত’, ‘উয়ো যো হাম মে তুম মে’ কিংবা মির্জা গালিবের রচিত ‘ইয়ে না থি হামারি কিসমৎ’ বাঙালির কাছেও কোনোদিনই পুরনো হবে না। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর লখনৌয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বেগম আখতার ১৯১৪ সালের আজকের দিনে (৭ অক্টোবর) ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.