জন্মদিনে স্মরণ : ক্যামেরার জাদুকর রশীদ তালুকদার
বাবলু ভট্টাচার্য
১৯৭১ সালে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন তারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্ত ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন কিছু মানুষ। জীবন বাজি রেখে তোলা তাদের সেইসব ছবি দিয়ে আজ আমরা ’৭১-কে দেখি, স্মরণ করি। যাদের ত্যাগে আজও ’৭১ জীবন্ত। অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলেছেন দেশের জন্য। তারাও যোদ্ধা, ক্যামেরাযোদ্ধা। এমন একজন যোদ্ধা রশীদ তালুকদার।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী হাহাকার, আহাজারি, কান্না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মানবিক অনুভূতি, নারী আন্দোলন ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি তার ক্যামেরার মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। তার ছবি বর্ণনা করেছে নির্যাতিতদের অব্যক্ত কথা। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে জাগ্রত করেছেন তিনি।
তার বাবা আবদুল করিম তালুকদার ছিলেন চাকরিজীবি এবং মা রহিমা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। বাবা স্টেশন মাস্টার হওয়ায় পৈত্রিক ভিটা মাদারীপুরের কালকীনি থানার দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামে হলেও তার জন্ম চব্বিশ পরগণায়। ১৯৫৭ সালে তার বাবা আবার বদলী হয়ে খুলনা থেকে রাজশাহী চলে আসেন।
পড়াশুনার পাট চুকিয়ে পেশা হিসেবে ফটো সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন রশীদ তালুকদার। কর্মজীবনে ১৯৫৯ সালে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে পিআইডি বা প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে ৮০ টাকা বেতনে যোগ দেন। এর পর ১৯৬২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ফটো সাংবাদিক বা আলোকচিত্রী হিসেবে যোগদান করেন। ফটো সাংবাদিক হিসেবে তাঁকে জীবনের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টটি দিয়েছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি শহীদুল্লাহ কায়সার।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে যান তিনি। ক্যামেরা হাতে ধারণ করেন যুদ্ধের সময়ের নানা ছবি। নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন বীরসেনাদের। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে রশীদ তালুকদার দৈনিক সংবাদ থেকে চলে এসে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। একাধারে ২৯ বছর চাকরি করে ২০০৭ সালে দৈনিক ইত্তেফাক থেকে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, রশীদ তালুকদার ছিলেন বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণ-অভ্যুত্থানের স্থির চিত্র হিসেবে মিছিলের সম্মুখভাগে টোকাই বা পথশিশুর ছবি তুলে সকলের নজর কাড়েন তিনি।
ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনে শহীদ আসাদের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রশীদ তালুকদার। তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ফুটে উঠেছিল ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি।
১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনকেও ক্যামেরায় ধারণ করেন রশীদ তালুকদার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে বুদ্ধিজীবীদের লাশ উত্তোলনের ছবিও তিনিই ধারণ করেন।
বাংলাদেশের বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে তার আলোকচিত্র। রশীদ তালুকদারের বিখ্যাত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাদার তেরেসার ছবি, মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, বুদ্ধিজীবিদের লাশ উত্তোলনের স্থিরচিত্র।
আলোক চিত্রকলায় অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণপদকসহ প্রায় ৭৭টি পুরস্কার লাভ করেন রশীদ তালুকদার। এর মধ্যে ২০০৬ সালে তাকে ‘ছবি মেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার’, ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অলাভজনক বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি’র পক্ষ থেকে ‘পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড’, জাতিসংঘ কর্তৃক ‘নিরাশ্রয়ের জন্য আশ্রয়’ শীর্ষক প্রতিযোগিতায় একত্রে ছয়টি পুরস্কার এবং জাপান ফটোগ্রাফিক সোসাইটি ও আশাহি শিমবুন পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় পরপর দুইবার পুরস্কৃত হওয়া অন্যতম।
২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ঢাকার আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের মৃত্যু হয়।
রশীদ তালুকদার ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে (২৪ অক্টো) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব