Take a fresh look at your lifestyle.

দুদকের মামলা:তবুও স্বপদে বহাল যশোর শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান-সচিব!

0

প্রতিবেদক: প্রশ্ন উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত হয়েও কিভাবে স্বপদে বহাল আছেন যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা। তাদেরকে স্বপদে রেখে সুষ্টু ও নিরপেক্ষ তদন্ত আদৌ সম্ভব ?।  

এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক যশোরের সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাস বলেন, দুদকের প্রাথমিক তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, মামলাও দায়ের হয়েছে, তাদের স্বপদে বহাল রাখলে তদন্তে প্রভাব পড়তে পারে।’
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলছেন, যাদের সংশ্লিষ্ঠতার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে, আইনত কিংবা নৈতিকতার কোনো বিবেচনাতেই তাদের স্বপদে থাকা যুক্তিযুক্ত মনে করি না।

চেক জালিয়াতির মাধ্যমে শিক্ষাবোর্ডের ৫ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার মধ্যেই রহস্যজনক অন্তর্ধানে থাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন সোমবার ঘণ্টা দেড়েকের জন্য অফিস করেছেন। আর মেডিকেল ছুটির আবেদন দিয়ে সটকে পড়া বোর্ড সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজারও কোনো হদিস মিলছে না। এ অবস্থায় আগামী মাসে শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রাপ্তির অনিশ্চয়তাসহ বোর্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ছন্দপতন ঘটেছে। এতে অস্বস্তিকর এক থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে পুরো অফিস জুড়ে।

জানা যায়, সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুদক গত ১৮ অক্টোবর পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওইদিন সন্ধ্যায় শিক্ষাবোর্ড ছেড়ে অজ্ঞাত গন্তব্যে চলে যান মামলার প্রধান আসামি বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন। যাবার আগে দাপ্তরিক কাজে গাজীপুরে যাচ্ছেন উল্লেখ করে অফিসিয়াল ফাইলে নোট রেখে যান। গত শুক্রবার তার অফিসিয়াল গাড়িটিও নিয়ে যান চালকসহ। তবে গাজীপুরে যশোর শিক্ষাবোর্ডের দাপ্তরিক কী কাজ থাকতে পারে তা জানেন না বোর্ড সংশ্লিষ্ঠরা। এছাড়া মামলা হবার দিনেই আটদিনের মেডিকেল ছুটির আবেদন রেখে একই সময় বোর্ড ছাড়েন সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজাও। তাদের অনুপস্থিতির মধ্যেই ২১ অক্টোবর ধরা পড়ে আরও আড়াই কোটি টাকা জালিয়াতি ও আত্মসাতের ঘটনা। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সম্পৃক্ততায় এমন বৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি সারাদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, ঘটনাটি যশোর শিক্ষাবোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
এদিকে, চেয়ারম্যান ও সচিবের অনুপস্থিতি ও জালিয়াতির ঘটনাকে ঘিরে অস্থিরতা ছড়িয়েছে বোর্ডজুড়ে। এরফলে শিক্ষাবোর্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যার সমাধান না হলে সময়মত ও সুষ্ঠুভাবে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণে সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকের। তবে যশোর শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক কে এম রব্বানী বলছেন, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির কারণে নাম সংশোধনসহ দু’একটি ব্যাপারে সামান্য সমস্যা হতে পারে। কিন্তু পরীক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়বে না। এ বোর্ডে প্রায় সব কাজই হয় অনলাইন পদ্ধতিতে। এসব কাজ যথানিয়মেই চলছে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে অনলাইন ফাইলেই চেয়ারম্যানের অনুমোদন নেয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর বৃহস্পতিবার অডিটকালে যশোর শিক্ষাবোর্ডে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের প্রথম ঘটনাটি ধরা পড়ে। সরকারি কোষাগারে জমার জন্য আয়কর ও ভ্যাট বাবদ ১০ হাজার ৩৬ টাকার ৯টি চেক ইস্যু করা হয়। এসব চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং এবং শাহী লাল স্টোর নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করা হয়। চেক জালিয়াতি করে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা আত্মসাত করা হলেও ব্যাংক থেকে পরিশোধিত চেক/অর্থের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান দুটি বোর্ডে কোনো মালামাল বা সেবা সরবরাহ করেনি। এসব অর্থ সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবোর্ড শাখার মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়েছে।
সূত্র জানায়, জুনিয়র অডিটর হিসেবে শেখ আব্দুর রফিক অডিট শাখায় গতবছরের ১০ মার্চ যোগ দেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের অডিট করার সময় গত ৪ অক্টেবর অনিয়মের বিষয়টি সর্বপ্রথম তার নজরে আসে। তিনি তিনদিন পরীক্ষার পর ‘পুকুরচুরির’ বিষয়টি আবিষ্কার করেন। ৭ অক্টোবর বিষয়টি জানাজানি হবার পর অডিট শাখার উপপরিচালক মো. এমদাদুল হককে দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

জুনিয়র অডিটর শেখ আব্দুর রফিক বলেন, ২০-২২টি ব্যাংকে শিক্ষাবোর্ডের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কিন্তু যে খাতেই টাকা ব্যয় করা হোক না কেন, তা অনুমোদনের পর সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবোর্ড শাখায় স্থানান্তর করে একমাত্র এই ব্যাংকের মাধ্যমেই পরিশোধ করা হয়। ফলে খরচ মেলানো খুবই সহজ। তিনি আরও জানান, প্রথম ঘটনাটি তিনি উদঘাটনের পর পরবর্তী ঘটনার ক্ষেত্রে তাকে আর যুক্ত করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষাবোর্ডের চেকবই প্রচলিত চেকবইয়ের মতো নয়। ব্যাংককে অর্ডার দিয়ে এটি বিশেষভাবে তিন স্তরে করা। প্রথম স্তরে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক লম্বা মুড়ি বইÑ যেখানে পেমেন্টের বিস্তারিত থাকে। দ্বিতীয় স্তরের উপরের অংশে চেক গ্রহিতার বিস্তারিত বর্ণনাসহ গ্রহণের স্বাক্ষর এবং তৃতীয় স্তরে প্রদানের চেক। এতকিছুর মধ্যে না জেনে, না দেখে বা না বুঝে চেক স্বাক্ষরের কোনো সুযোগই নেই। আর দু-এক হাজার টাকার পেমেন্টের মুড়ি বইতে লক্ষ লক্ষ টাকা পেমেন্ট হয়ে গেল, এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
শিক্ষাবোর্ডের গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রধান কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানি বলেন, প্রথমে ৯টির সাথে পরে আরও একটি চেক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এসব তদন্তের জন্য ৭ কর্মদিবস সময় দেয়া হয়। কিন্তু প্রধান অভিযুক্ত আব্দুস সালাম আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় আরও ৩ দিনের সময় বৃদ্ধির আবেদন করেন। এরই মধ্যে নতুন করে আরও ১৬টি চেক জালিয়াতির ঘটনা জানা যাওয়ায় আরও ৭ কর্মদিবস সময় দিয়ে তাকে ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সোমবার থেকে তা শুরু হয়েছে।
এদিকে নতুন যে চেক জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে, সে সময়ও বর্তমানের চেয়ারম্যান মোল্লা আমীর হোসেন সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। হিসাব ও নীরিক্ষা বিভাগের উপপরিচালকের দায়িত্বে এমদাদুল হক এবং অডিট অফিসার আবদুস সালাম ছিলেন। এই একই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বহিরাগতদের সহায়তায় চক্রটি বোর্ডের কোটি কোটি টাকা সরিয়ে ফেলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরমধ্যে অডিট অফিসার আবদুস সালাম এককভাবে তিনি টাকা আত্মসাতে দায়ী এবং দুই দফায় ৩০ লক্ষ টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে তিনি পলাতক অবস্থায় ফেরৎ দিয়েছেন। এই ফেরৎ দেয়ার নাটকের সাথেও পুরো সিন্ডিকেট জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হিসাব ও নীরিক্ষা বিভাগের উপপরিচালক এমদাদুল হক বলেন, চেকের মুড়িবই এবং জালিয়াতির চেকের ফ্রন্টের মধ্যে পার্থক্য আছে। এটা জালিয়াতির জন্য নতুন কোনো প্রযুক্তি কিনা ভাববার বিষয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার শাখার যারা জুনিয়র তাদের ওপর নির্ভর করে আমি চেক ছেড়েছি। তবে এ ঘটনায় তিনি দায় এড়াতে পারেন না বলে এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন।
এদিকে, বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন অন্তর্ধান থেকে  সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় কার্যালয়ে আসেন। এ সময় সিন্ডিকেটের সাথে সংশ্লিষ্ঠরা তাকে রিসিভ করে তার দপ্তরে নিয়ে যান। এ ঘটনায়ও বোর্ডে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অফিসে অবস্থানকালী দেড়ঘণ্টা সময়ের বেশিরভাগই তিনি গণমাধ্যমকে নিয়ে বিষোদগার এবং পরিত্রাণের পথ বাতলানোর জন্য ঘণিষ্ঠদের সাথে শলাপরামর্শ করেন বলে সংশ্লিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে। দুপুর একটায় তিনি মোবাইলে বলেন. আমি খুলনায় একটি কুয়েটের নিয়োগ বোর্ডে যাচ্ছি বলে দেখা করা সম্ভব নয়। তবে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বলেন, আমি শিক্ষাবোর্ডকে শতভাগ হয়রানিমুক্ত করেছি। আমিই সব অনিয়ম আবিষ্কার করেছি। আমার সম্পৃক্ততার প্রশ্নই পড়ে না।

Leave A Reply

Your email address will not be published.