জন্মদিনে স্মরণঃ মরমি শিল্পী আব্বাস উদ্দিন
বাবলু ভট্টাচার্য
নদী বেষ্টিত উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, দুঃখ কষ্ট আর হাহাকারের কথা উঠে এসেছে ভাওয়াইয়া গানে। অনাদিকাল থেকে এই গানই বাঁচিয়ে রেখেছে কুড়িগ্রামসহ আশপাশের এলাকার ভাষা ও সংস্কৃতিকে। ভাওয়াইয়া গানকে যিনি পরিচিত করেছেন সারাদেশে, সারা বিশ্বে তিনি শিল্পী আব্বাস উদ্দিন। আব্বাস উদ্দিন ১৯০১ সালের আজকের দিনে (২৭ অক্টোবর) ভারতের কোচবিহার জেলার কালজানি নদীর নিকটবর্তী বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাওয়াইয়া গানের মূল বৈশিষ্ট নারী মনের হাহাকার-আতৃপ্তি- আকুতি। আর সেই আকুতি বেশির ভাগ সময়েই সুরে সুরে তুলে ধরেছেন পুরুষ শিল্পীরা। আব্বাসউদ্দিন তেমনিই এক গুণি শিল্পী যিনি গ্রামীণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর সরল ভাষার গানকে তুলে ধরেছেন সকলের সামনে। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গানে নারী প্রেমের চরম আকুতি উঠে এসেছে। আব্বাসউদ্দিন শুধুমাত্র ভাওয়াইয়া গানই করেন নি। তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন বাংলা ভাষায় ইসলামিক সংগীত করা সম্ভব। তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন ইসলামিক অসংখ্য গান। আজও কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ও তাঁর গাওয়া- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ বাঙালি মুসলমানদের প্রিয় ঈদের গান।
বিভিন্ন রাজনৈতিক মঞ্চে গান গেয়ে তিনি বাঙালি মুসলমানকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধও করেছেন। বাঙালি মুসলমানকে যেমন তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন তেমনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হিন্দু-মুসলমানদের উদ্দেশ্যে গেয়েছেন- ‘হিন্দু আর মুসলিম মোরা দুই সহোদর ভাই’ কিংবা- ‘ও ভাই হিন্দু মুসলমান ভুলপথে চলি দোঁহারে দু’জনে কোরো নাকো অপমান।’ এছাড়া উর্দু, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, মার্সিয়া, পালাগান গেয়েছেন। শুধু গানই নয় আব্বাস উদ্দিন ৪টি চলচ্চিত্রে অংশ নেন। সেগুলো হলো ‘বিষ্ণমায়’ (৩২), ‘মহানিশা’ (৩৬), ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’ (৪০)।
ভারতে জন্ম নেয়া আব্বাস উদ্দিন ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর ঢাকায় স্থায়ী হন। তার কন্ঠের গান দিয়েই শুরু হয় তৎকালীন স্বাধীন রেডিও সম্প্রচার। তার গাওয়া সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত গান ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাকও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর….’আব্বাস উদ্দিনই সম্ভবত প্রথম বাঙালি শিল্পী যিনি ১৯৫৫ সালে ম্যানিলায় এবং ১৯৫৬ সালে জার্মানীতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত কাউন্সিলের অধিবেশনে ভাওয়াইয়া গানসহ বাংলার পল্লীগীতির পরিচয় করে দিয়েছেন।
‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ তার রচিত একমাত্র গ্রন্থ। তিনি সঙ্গীতের অবদানের জন্য মরনোত্তর প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬০),
শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯) এবং স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৮১) ভূষিত হন। উল্লেখ্য তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মোস্তফা জামান আব্বাসী এবং কন্যা ফেরদৌসি রহমান ও খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী। ভাওয়াইয়া গানের জনক আব্বাস উদ্দীন আহমদ ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৫৮ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব