বাবলু ভট্টাচার্য
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত পায়। কিন্তু এই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৪৮ সালে। ভাষা আন্দোলনে সেই সময়কার প্রবীণ যে কজন রাজনীতিবিদ অংশ নেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। তিনি ছিলেন সেই সময়কার পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষা হবে উর্দু এবং ইংরেজি তা প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এবং এই অধিবেশনের ব্যবহার্য ভাষা হিসেবে উর্দু এবং ইংরেজিতে শুরু হলে তার প্রতিবাদ করেন ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত।
অধিবেশনের শুরুতে আলোচনার সূত্রপাত করেন কংগ্রেস দলীয় গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের শুরুর প্রথম ভাষণে বলেন, গণপরিষদের যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায়। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই ইংরেজি এবং উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে গণপরিষদে ব্যবহার করার প্রস্তাব রাখছি।
গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্র নাথের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, দেশের ছয় কোটি নব্বই লাখ নাগরিকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে, তাহলে আপনিই বলুন মাননীয় সভাপতি রাষ্ট্র ভাষা কি হওয়া উচিত।
১৯৪৮ সালের ২৫ তারিখে গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বানের নোটিস জারি হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত তার একটি সংশোধনী প্রস্তাব দাখিল করেন, তার মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল ২৯ নং বিধির ১ নং উপবিধিতে উর্দু এবং ইংরেজির পর বাংলা শব্দটি সংযুক্ত করার।
২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের জমা দেয়া প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন মাত্র তিনজন গণপরিষদের সদস্য। তারা হলেন, প্রেমহরি বর্মা, ভুপেন্দ্র কুমার দত্ত, শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তী তার প্রস্তাবকে সমর্থন করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন গণপরিষদের অধিবেশনে।
কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তী তার বক্তব্যে বলেছিলেন, উর্দু পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোনো একটিরও ভাষা নয়, বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য চাপ দিচ্ছি না, শুধু সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি চাই।
গণপরিষদে এই প্রস্তাব বিল উপস্থাপন করা জন্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানি শাসকের রোষানলে পড়েন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম সৈনিক ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের উপস্থাপিত প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে সেই দিন গণপরিষদে বক্তব্য রাখেন তখনকার পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, মোহাজের ও পুনর্বাসনমন্ত্রী গজনফর আলী খান, পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং গণপরিষদের সহসভাপতি তমিজউদ্দিন খান।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তার বক্তৃতায় বলেন, পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা ও একটি সাধারণ ভাষা দ্ধারা ঐক্য সূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবিত বিলের উদ্দেশ্য। লিয়াকত আলী বাংলা ভাষা গণপরিষদে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সেদিন বক্তব্য রেখেছিলেন। ওই অধিবেশনে মিথ্যাচার করে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন তার বক্তব্যে বলেন, পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের মনোভাব হলো তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চায়।
গণপরিষদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে বিল পাস হয়। বিল পাস হওয়ার সময় তীব্র প্রতিবাদ করেন ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত।
ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা কতখানি জানেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ানোর সময় তার কথা কতটুকু পড়ানো হয়? শুধু নতুন প্রজন্মকে না জানার দোষ দিয়ে লাভ নেই, যারা ইতিহাসের পাঠ্যসূচি বা কারিকুলাম লিখেন তারা কতটুকু গুরুত্ব সহকারে এই ভাষাসৈনিককে চিত্রিত করেন তা দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথাটি গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বিলের মাধ্যমে প্রস্ফূটিত হয়েছিল, যা বোঝা যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর দেয়া গণপরিষদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। লিয়াকত আলীর বক্তৃতার সারমর্মটা ছিল এমন : বাংলা একটি সাধারণ ভাষা, এটা দিয়ে নাকি ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চান।
ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের পিতা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন মুন্সেফ কোর্টের সেরেস্তাদার। লেখাপড়া শেষ করে প্রায় এক বছর তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর বাঙ্গুরা উমালোচন হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তারপর তিনি যোগ দেন কুমিল্লা বারে অ্যাডভোকেট হিসেবে। সেই থেকে তিনি রাজনীতিতে সংক্রিয় হয়ে উঠেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে তিনি সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণর শাসনের বিরুদ্ধে ছাঁটাই বিল উপস্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার প্রতি ছিল মারমুখী ক্ষিপ্ত। কারণ তিনি পূর্ব বাংলার ন্যায্যতার দাবিতে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সংসদে লড়েছেন।
ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপোস করেননি। তার এই অপোসহীনতা এবং সংগ্রামী মনোভাবকে পাকিস্তানি শাসকরা ভয় পেত- তাই তারা নানা কৌশল খুঁজছিল কীভাবে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকে দমন করা যায়।
পাকিস্তানি সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকরা একটি আইন পাস করে। আইনটির নাম এবডো। এই এবডোর প্রয়োগ করা হয় ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের ওপর, কারণ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। এবডোর ফলে তিনি সব নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষিত হন। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। ’৬৯ সহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নেপথ্য থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন শুরু করলে, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হায়েনার দল ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ও তার পুত্র দীলিপ কুমার দত্তকে গ্রেফতার করে।
পিতা ও পুত্রকে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। কুমিল্লা সেনানিবাসের টর্চার সেলে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ও তার পুত্র দিলীপ কুমারের ওপর পাকিস্তানি হায়েনার দল অমানবিক নির্যাতন চালায়। অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানি পশুরা পিতা ও পুত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের আজকের দিনে (২ নভেম্বর) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব