জন্মদিনে স্মরণ : বেণীমাধব দাস
বাবলু ভট্টাচার্য :
আমাদের ইতিহাস বিস্মৃত এবং সাধারণভাবে তথ্যায়ন বা ডকুমেন্টেশনে অনীহাপরায়ণ জাতির মনের আড়ালে বিস্মৃত একটি নাম বেণীমাধব দাস। অথচ আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর মতো শিক্ষক ও নানা বিষয়ে পন্ডিত একজন মানুষের অবদান অপরিসীম।
বেণীমাধব দাসের পিতার নাম কৃষ্ণচন্দ্র দাস। দর্শন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করার পর তিনি প্রথম চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। দর্শন ছাড়াও তিনি অর্থনীতি ও ইতিহাসে পন্ডিত ছিলেন। তাঁর হাতে চট্টগ্রাম কলেজ একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। পরে তিনি ঢাকা, কটক র্যাভেনশ স্কুল, কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল ও কলকাতার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেছেন।
ব্রাহ্মসমাজের নেতা মনীষী কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে তিনি প্রথম জীবনে ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। বিবাহ করেছিলেন কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক মধূসূদন সেনের কন্যা সারদা দেবীকে। সারদা দেবীও স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী ছিলেন। তিনিও সমাজ ও দেশসেবায় সক্রিয় অংশ নিয়েছেন।
বেণীমাধব ব্রাহ্মসমাজ প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’ ও ‘নববিধান’ পত্রিকা দুটির সঙ্গে লেখক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ এর কাকিনাড়ায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া থেইস্টিক কনফারেন্সের সভাপতিত্ব করেন তিনি। সভাপতি হিসাবে তাঁর ভাষণ পরে মডার্ন থেইস্টিক মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া নামক পুস্তিকায় প্রকাশ করা হয়। তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘পিলগ্রিমেজ থ্রু প্রেয়ার্স’ সমালোচকদের কাছে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেছিল।
দেশপ্রেম ও শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন বেণীমাধব। তাঁর হাতে ছাত্র হিসেবে তৈরি হয়েছেন অসংখ্য দেশপ্রেমিক বিপ্লবী। তাঁর মধ্যে অন্যতম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও শরৎচন্দ্র বসু। ১৯০৯ সালে কটকের কাঠাজুড়ি নদীর তীরে বাংলা মাধ্যম র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন সুভাষ। বেনীমাধব দাস তখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশচেতনা প্রথম সুভাষকে প্রভাবিত করে। সুভাষের ভেতরে যে আগুন আছে তা এই শিক্ষকের চোখ ঠিক আঁচ করতে পেরেছিল।
পরাধীনতা থেকে দেশের মুক্তির উপায় প্রসঙ্গে নানা আলোচনায় সুভাষের মনে দেশপ্রেমের দীক্ষাবীজ বপন করে দেন বেনীমাধব দাস। তিনি এই প্রতিভাবান কিশোরকে উদ্বুদ্ধ করেন স্বামী বিবেকানন্দের রচনা পাঠ করতে। সুভাষচন্দ্র পরে তাঁর স্মৃতি কথায় এই দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন : বেণীমাধব ছাত্রদের অকুন্ঠ উৎসাহ দিতেন নানা বিষয়ে বই পড়তে এবং পরে তা নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের সক্রিয়ভাবে সমাজসেবায় অংশ নিতেও উৎসাহ দিতেন।
১৯১১ সালের ১১ অগাস্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরামের তৃতীয় শহীদ দিবস পালিত হয় কটকের ঘরে ঘরে অরন্ধন ও অনশন পালনের মাধ্যমে। ছাত্র সুভাষের নেতৃত্বে ছাত্রদের একটি দল ছিল এর প্রধান উদ্যোক্তা। আর এ কাজে প্রধান শিক্ষক বেনীমাধব বাবুর প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল। তার ফলে বেনীমাধব বাবু বৃটিশ সরকারের নির্দেশে কটক থেকে বদলী হন কৃষ্ণনগরে।
কৃষ্ণনগর থেকে সুভাষকে লেখা বেনীমাধব বাবুর পত্র নিয়ে, স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কটক আসেন তাঁরই সমবয়সী হেমন্তকুমার সরকার নামে এক তরুণ। সুভাষ যে মনেপ্রাণে অস্থির হয়ে খুঁজছেন পথনির্দেশ, তা বুঝেই তিনি তরুণ হেমন্তকে পাঠান সুভাষের কাছে। এই হেমন্তই সুভাষকে প্রথম রাজনৈতিকভাবে প্রেরণা দেন, কলকাতায় তার দলের বিষয়ে এমন সব তথ্য দেন যা সুভাষের মনে গভীর ছাপ ফেলে।
এহেন শিক্ষকের নিজের গোটা পরিবার স্বাভাবিক ভাবেই বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিল। বিশেষত তাঁর কন্যারা সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর মেজছেলে কারাবরণ করেন। বড়মেয়ে কল্যাণী দাস সমাজ সেবা ও বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি ছাত্রী সংঘের উদ্যোক্তা ছিলেন এবং ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতির জন্য কারাবরণ করেন। ছোট মেয়ে বাংলার প্রখ্যাত অগ্নিকন্যাদের অন্যতম বীণা দাস (ভৌমিক), যিনি ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অতিথি বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করবার চেষ্টা করেন।
বেণীমাধব দাস পরাধীনতার অবসান দেখে যেতে পেরেছিলেন, যদিও দাঙ্গাবিধ্বস্ত, বিভক্ত দেশ তাঁকে অপরিসীম বেদনা দিয়েছিল।
তাঁর অগণিত ছাত্র ও সন্তানদের আত্মত্যাগের ফলে স্বাধীন হওয়া দেশের মাটিতে, কলকাতায় ১৯৫২ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি প্রয়াত হন ৷
বেণীমাধব দাস ১৮৮৬ সালের আজকের দিনে (২২ নভেম্বর) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার শেওড়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব