Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ কামরুল হাসান

0

বাবলু ভট্টাচার্য:

কামরুল হাসান বিখ্যাত বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী। তিনি ড্রইং-এ দক্ষতা অর্জন করে বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছিলেন। কামরুল হাসানকে সবাই শিল্পী বললেও তিনি নিজে ‘পটুয়া’ নামে পরিচিত হতে পছন্দ করতেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে কামরুল হাসান এর আকা জেনারেল ইয়াহিয়ার মুখের ছবি দিয়ে আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ পোস্টারটি খুব বিখ্যাত আজও।

তাঁর পুরো নাম এ.এস.এম. কামরুল হাসান অর্থাৎ আবু শরাফ (শার্ফ) মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তাঁর ডাকনাম ছিল সাতন।

কামরুল হাসানের জন্মের আগে তাঁর মা’র পরপর কয়েকটি সন্তানের মৃত্যু হলে তখনকার সংস্কার অনুযায়ী তাঁকে সাতকড়ির বিনিময়ে কেনা হয় বলে তাঁর নাম হয় সাতকড়ি; সংক্ষেপে সাতন। তাঁর বাবার নাম মোহাম্মদ হাশিম ও মার নাম মোসাম্মৎ আলিয়া খাতুন।

কামরুল হাসান ১৯৩৭ সালে বাবার আগ্রহে কলকাতা মাদ্রাসার অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন।

কামরুল হাসান যখন কলকাতা মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখন পড়ালেখার চাইতে ছবি আঁকায় মেতে থাকতেন বেশি। সে মাতামাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছালো যে পরীক্ষা দিয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠার পরিবর্তে আর্ট স্কুলে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিলেন।

আর্টস্কুলে পাস করে, ভর্তির ফরম নিয়ে বাবাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাকে কোন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে একটি পরিচয়পত্র এনে দেন বাবা তাকে নিয়ে যান খান বাহাদুর ওয়ালিউল ইসলাম সাহেবের কাছে।

তিনি খুব স্নেহভরে তার ড্রইং খাতার ওপর চোখ বুলিয়ে তাঁর নিজস্ব প্যাডে কয়েক লাইন লিখে দিলেন। আর এভাবেই ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে কামরুল হাসান কলকাতার ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস’-এ ভর্তি হন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কামরুল হাসান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’-এ যোগ দেন। সুভাষচন্দ্র বসুর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েই তিনি এই দলের সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ শুরু হলে এই নিয়ে চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকেন। কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টি দুর্ভিক্ষ নিয়ে আঁকা চিত্রকর্মের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কামরুল হাসানের চিত্রও এই প্রদর্শনীতে ছিল।

‘মণিমেলা’ ও ‘মুকুল ফৌজ’ এই বিখ্যাত দুই শিশুকিশোর সংগঠনের সঙ্গে কামরুল হাসান ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ‘মুকুল ফৌজ’-এর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। কামরুল হাসানের সাংগঠনিক দক্ষতায় মুকুল ফৌজের কার্যক্রম দ্রুত প্রসার লাভ করে।

অর্থ উপার্জনসহ নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে আর্ট স্কুলে ছ’বছরের কোর্স শেষ করতে কামরুল হাসানের ন’বছর লেগেছিল। ভারত বিভাগের পরে, কামরুল হাসান ঢাকাতে চলে আসেন ।

১৯৪৭ সালের শুরুর দিকেই কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হকসহ আরও অনেকে ঢাকায় এসে একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করছিলেন। কামরুল হাসান তখনও ছাত্র। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কামরুল হাসানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং আর্ট স্কুলের বাইরে নানা কাজে তিনি তাঁদের সঙ্গী ছিলেন। ফলে কামরুল হাসানও এসব আলোচনা পরিকল্পনার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

সবার সহযোগিতায় অবশেষে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্টস’, যা বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট। এখানে কামরুল হাসান এগারো বছরেরও বেশি সময় শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।

রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধই তাঁকে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বরাবর সক্রিয় রাখে। ১৯৫২ সালে এদেশে প্রথম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে আর্টস ইনস্টিটিউটের ছাত্র আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, ইমদাদ হোসেন, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ সক্রিয় ছিলেন। লেখা হতো বিভিন্ন স্লোগান ও দাবি সম্বলিত ব্যানার। ছাত্র-শিল্পীদের সঙ্গে কামরুল হাসানও সেদিন এসব কাজে সক্রিয় ছিলেন।

১৯৬০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি শিল্প প্রদর্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় কামরুল হাসানের একটি একক শিল্পকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়া ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডি সোসাইটি অফ কনটেমপোরারি আর্ট গ্যালারিতে তাঁর একটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে শিল্পী কামরুল হাসানের বেশ কয়েকটি একক শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া যৌথ প্রদর্শনীতে তাঁর অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকে।

এরপর ১৯৬০ সালের ১৬ মার্চ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার ডিজাইন সেন্টারে চিফ ডিজাইনার হিসেবে তিনি যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও রেডিও-এর কলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষার্ধে কামরুল হাসান সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের যে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়েছিল সেই পতাকার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় পতাকার রূপ দেন।

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পাশাপাশি তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি প্রতীকেরও ডিজাইন করেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ বিমান। এছাড়া আরও আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতীক অঙ্কন। বাংলাদেশের সংবিধানের কভার ডিজাইনেরও রূপকার তিনি।

১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার দানবমূর্তি সম্বলিত পোস্টার এঁকে বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। এখানে তার নেতৃত্বে কাজ করেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, জহির আহমদ প্রমুখ। এই শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রচনা করেন একাধিক পোস্টার।

এসব পোস্টারের মাধ্যমে পাকবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনে দেশের জন্য যুদ্ধের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও সৃষ্টি হয়।

ঢাকা শহরে বৈশাখী মেলা আয়োজনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন কামরুল হাসান। বাঙালিত্বের চেতনা প্রসারের লক্ষ্যেই তিনি ঢাকায় বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন।

১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯টা ৩৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা ফাউন্ডেশন শিল্পী কামরুল হাসানকে তাঁর শিল্পকর্মের জন্য স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৭৯ সালে তিনি লাভ করেন ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’। ১৯৮৪ সালে কামরুল হাসান ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মান’ লাভ করেন।

ওই বছরই তাঁর বিখ্যাত তৈলচিত্র ‘তিনকন্যা’ অবলম্বনে একটি সুদৃশ্য ডাকটিকেট প্রকাশ করে তৎকালীন যুগোশ্লাভ সরকারের ডাক, তার ও টেলিফোন বিভাগ ২ ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালে । কোনো বিদেশী সরকার কর্তৃক বাংলাদেশি কোনো শিল্পীর শিল্পকর্ম সম্বলিত ডাকটিকেট প্রকাশের ঘটনা এটাই প্রথম।

১৯৮৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো মনোনীত হন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ তৃতীয় দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে কামরুল হাসানের ‘নাইওর’ চিত্রকর্মটি অবলম্বনে ৫ টাকা মূল্যমানের একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে।

চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান ১৯২১ সালের আজকের দিনে (২ ডিসেম্বর) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনা থানার নারেঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.