Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণ : উদয়শঙ্কর

পাশ্চাত্যের মানুষ ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় বলতে যে তিন মহাবলী তথা টেগোর গান্ধি এবং শঙ্করকে বুঝত- এই উদয়শঙ্কর ছিলেন তাদের অন্যতম

0

বাবলু ভট্টাচার্য :

জীবন যার শুরু হয়েছিল আর্ট কলেজে ছবি আঁকা শেখার জন্য, তার তো জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার কথা ছিল চিত্রশিল্পী হিসেবেই। কিন্তু তা হলো না। তিনি প্রতিষ্ঠা পেলেন বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী হিসেবে। তিনি আর কেউ নন, নৃত্যগুরু উদয়শঙ্কর।

উদয়শঙ্করের বাবা ছিলেন বিখ্যাত আইনজীবী শ্যামশঙ্কর চৌধুরী এবং মা হেমাঙ্গিনী দেবী। বাবার ছিল বিশাল অর্থ- প্রতিপত্তি।

কিন্তু জীবনের প্রথম পর্বেই তাকে পড়তে হয়েছিল অর্থ সংকটে। অর্থ সংগ্রহের জন্য তাকে নামতে হয়েছিল জীবন সংগ্রামে। কারণ, অতি বাল্যকালেই তাকে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়। পিতার আকস্মিক মৃত্যু ফলেই সৃষ্টি হয়েছিল এই দুর্যোগের।

ফলে মা আর ছোট তিন ভাইয়ের দেখাশোনার ভার পড়ে বড় ভাই উদয়শঙ্করের ওপরেই। তার তিন ভাই হলেন রাজেন্দ্রশঙ্কর, দেবেন্দ্রশঙ্কর ও রবিশঙ্কর। উত্তরকালে রবিশঙ্কর বড় ভাইয়ের মতোই সংগীতে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন।

বাল্যকালে চিত্রশিল্পের দিকেই ঝোক ছিল উদয়শঙ্করের। তাই ১৯১৭ সালে তিনি ভর্তি হন বোম্বাইয়ের জে. জে. স্কুল অব আর্টস-এ। এখান থেকেই তিনি ১৯১৯ সালে কলাবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করেন। তারপর ১৯২০ সালে সেখানকার কলেজ অব আর্টস থেকে সমাপ্ত করেন স্বর্ণপদক আর ডিস্টিংসনসহ কলাশিক্ষার পাঠ।

কিছু ছবি আঁকার শিক্ষা সমাপ্ত করলেও পেশাগত জীবনে চিত্রশিল্পকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন না। ছাত্রজীবনেই তিনি বোম্বাইয়ের এক স্টেজ প্রোডাকশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তারপর অনেকটা আকস্মিকভাবেই তিনি মেতে উঠেন নাচ নিয়ে। এই সময়ই তার সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনা পাভলোভার।

তিনিই উদয়শঙ্করকে নিজের ব্যালেতে নৃত্যশিল্পী হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে রাধাকৃষ্ণ ও ইন্ডিয়ান ম্যাসেজ এর প্রধান নৃত্যশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন।
বস্তুত এভাবেই তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী হিসেবে দর্শক সাধারণের সপ্রশংসা দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন।

গোটা ইউরোপ দেখতে পেল দিব্যকান্তি তরুণের নৃত্যভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের জীবনইতিহাস, সংস্কৃতি আর কিংবদন্তির এক মূর্ত রূপ। এই সময় তার ইউরোপের বহু খ্যাতনামা জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে ওঠে। রম্যা রলা, সিলভ্যা লেভি, ইহুদি মেনুহিন প্রমুখ অসাধারণ মনীষীর সঙ্গে গড়ে ওঠে তার নিবিড় সখ্য।

১৯২৯ সালে উদয়শঙ্কর তার নৃত্যশৈলী প্রদর্শনের মাধ্যমে ইউরোপ জয় করে ফিরে এলেন স্বদেশে। এরপর গোটা ভারত জুড়ে শুরু করলেন তার নৃত্যশিল্পের অভিযান।

স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি আলমোড়ায় স্থাপন করলেন উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার নামে একটি নৃত্যশিক্ষাকেন্দ্র। এখানেই তিনি রচনা করেন নতুন মঞ্চপ্রকরণ সহযোগে বিশ্বজোড়া খ্যাতির অধিকারী রামলীলা। তার এই শিল্প অভিযানের সঙ্গে যুক্ত হন গুরু শঙ্করণ নাম্বুদ্রিকন্দ্রপ্লন পিল্লাই, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং তিমিরবরণের মতো বহু মহাগুণবান শিল্পী।

উদয়শঙ্করের নৃত্যভঙ্গিমায় সবচেয়ে বেশী প্রভাব পড়েছে কথাকলি নৃত্যের। তার কাহিনী স্রোতকেই তিনি তার নাচের ভঙ্গিমার মুখ্য অভিপ্রকাশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সেই সঙ্গে মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন ভরতনাট্যমের মনিপুরী নাচের প্রকাশরীতি এবং জাভা ও বালিদ্বীপের তালবাদ্য।

১৯৩০ সালে উদয়শঙ্কর তার দলবল নিয়ে উপস্থিত হন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। ১৯৩০ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি আলেকজান্ডারের মতো আপন মহিমায় অভিযান করে বেড়ান সারা ইউরোপ তথা বিশ্বময়। পাশ্চাত্যের মানুষ ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয় বলতে যে তিন মহাবলী তথা টেগোর গান্ধি এবং শঙ্করকে বুঝত- এই উদয়শঙ্কর ছিলেন তাদের অন্যতম।

অমলাকে বিয়ে করাও ছিল উদয়শঙ্করের জীবনের আর এক রহস্যময় ব্যাপার। গোটা পৃথিবী যখন জানত উদয়শঙ্করের স্ত্রী হবেন নৃত্যশিল্পী সিমকি, ঠিক তখনই তিনি অমলাকে জীবনসঙ্গীন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
উদয় অমলার ঘরে জন্ম নিয়েছেন দুজন স্বনামধন্য শিল্পী। এদের একজন প্রয়াত সন্তান সংগীতশিল্পী আনন্দ শঙ্কর এবং অন্যজন নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী শ্রীমতি মমতা শঙ্কর।

আলমোড়ার কলাকেন্দ্র ভেঙে যাবার পর আবার একদিন উদয়শঙ্কর তার দলবল নিয়ে বের হন বিশ্ব অভিযানে। ইউরোপ আমেরিকা ও চীনের পথে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত উদয়শঙ্করের নৃত্য শৈলীকে আধার করে তৈরি হয়েছে একটি ছায়াছবি, যার নাম ‘কল্পনা’।

১৯৬২ সাল থেকে উদয়শঙ্কর কলকাতায় স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বাস করতে থাকেন। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে তিনি রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য সামান্য ক্ষতি মঞ্চস্থ করেন।

১৯৭০ সালে ছায়াছবি আর নৃত্য নাট্যের সংমিশ্রণে তার অভিনব সৃষ্টি শঙ্করস্কোপ। এই শঙ্করস্কোপই তার শিল্পী জীবনের সর্বশেষ কীর্তিস্তম্ভ, যা বিশ্বে নতুন এক মঞ্চরীতির ইতিহাস রচনা করেছেন।

শিল্পে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভুষণ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৫৫ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সঙ্গীত নৃত্য একাডেমীর আচায্যের দায়িত্বও পালন করেন।

উদয়শঙ্কর ১৯০০ সালের আজকের দিনে (৮ ডিসেম্বর) যশোর জেলার (বর্তমানে নড়াইল) কালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.