একটি দেশের স্বাধীনতার পেছনে যেমন থাকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস তেমনি থাকে সঙ্গীত-সংস্কৃতির ইতিহাস। কাজেই স্বাধীনতার গানের মূল্যায়ন করতে হলে ফিরে যেতে হবে গণসঙ্গীতের ইতিহাসে। আর এর পেছনে থাকে সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের নিরলস সংগ্রাম।
কালের ডামাডোলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তের দাগ মুছে গেছে, কিন্তু আজও তাঁর স্বাধীনতার গান আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ও জাজ্বল্যমান। এখনো রক্তে নাড়া দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ। তিনি সমর দাস।
সমর দাস ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান পরিচালক ছিলেন। ওই সময় অনেক গানে তিনি সুর করেন। তার সুর করা গান যুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনী ও সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করত। মুক্তিযুদ্ধে তার সুর করা ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘চিরদিন আছে মিশে’ এবং ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা’ গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সুরবিন্যাস করে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ মূল গানটি বিবিসি লন্ডন থেকে সামরিক ব্রাশব্র্যান্ডে রেকর্ড করার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
পরিবারের কাছেই সমর দাসের সংগীত শিক্ষা শুরু হয়েছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রে বংশীবাদক হিসেবে সংগীত জীবনের সূচনা করেন। অল্প বয়সেই গিটার ও পিয়ানো বাজানোর জন্য তার চারদিকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চাশের দশকে তিনি কলকাতায় হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানিতে কাজ করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে সংগীতপরিচালক হিসেবে যোগ দেন সমর দাস।
বাংলা ছায়াছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও সমর দাসের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৫০ সালে কলকাতার বাংলা ছবি ‘লটারি’র অন্যতম সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি।
এছাড়া প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ ছায়াছবির সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য দুই হাজারেরও বেশি গানে সুর করেছেন। ১৯৮৫ ও ১৯৯৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমস সূচনা সংগীতের সুরও তিনি করেন।
সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‘একুশে পদক’ এবং ‘স্বাধীনতা পদক’সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন।
বাঙালির ঐতিহ্য হাজার বছরের। যতদিন বাঙালি থাকবে, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন স্বাধীনতার গান বেঁচে থাকবে আর পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠার মতোই— তিনিও যুগ যুগ ধরে আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সমর দাস পরলোক গমন করেন।
সমর দাস ১৯২৯ সালের আজকের দিনে (১০ ডিসেম্বর) পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন।