শুভ জন্মদিন রিজিয়া রহমান
বাবলু ভট্টাচার্য:
স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে সব নতুন ঔপন্যাসিকের আগমন ঘটেছে রিজিয়া রহমান তাঁদের অন্যতম। বিষয় বৈচিত্র এবং শৈল্পিক উত্কর্ষে তাঁর উপন্যাসসমূহ বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অর্জন করেছে স্বতন্ত্র মাত্রা।
ষাটের দশকের এই নামী কথাসাহিত্যিক জন্মেছিলেন কলকাতার ভবানীপুরে। বাবা ডাক্তার আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক। মা গৃহিনী মরিয়াম বেগম।
রিজিয়া রহমান কর্মজীবনে একাধিক কর্ম ও একাধিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের মাঝে সাহিত্য পত্রিকা ‘ত্রিভূজ’ এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
তাঁর ‘ঘর ভাঙা ঘর’ বস্তিজীবনের ক্লেদাক্ত যন্ত্রণার শব্দরূপ; আর ‘রক্তের অক্ষর’ হচ্ছে নিষিদ্ধ পল্লীর যন্ত্রণাদগ্ধ প্রাত্যহিকতার ভাষাচিত্র। চট্টগ্রামের হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দৈনন্দিনতা নিয়ে গড়ে উঠেছে রিজিয়া রহমানের ‘উত্তর পুরুষ’।
‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসে রিজিয়া রহমান বাঙালির ইতিহাস সন্ধানী এবং সমকালস্পর্শী। শ্রম অধ্যবসায় ইতিহাসজ্ঞান এবং শিল্প চেতনার অন্তরমিলনে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল শিল্পকর্ম। এখানে সঙ্গত কারণেই ইতিহাসকে তিনি স্বচ্ছন্দ প্রয়াসে পরিণত করেছেন শিল্পে এবং শিল্পের দাবীতে, ইতিহাসের ধূসরতায় মিশেছে কল্পনার সৌরভ।
ভারত উপমহাদেশের প্রান্তসীমায় অবস্থিত বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা মানুষ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী সামাজিক অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার, তাদের দেশ প্রেম আর স্বজাত্যবোধের গৌরব আর সাহসের অনুপম শিল্পরূপ রিজিয়া রহমানের উপন্যাস ‘শিলায় শিলায় আগুন’। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিলুচিস্তানের বিদ্রোহ ও কালাতের যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস।
উত্তর বাংলার সাঁওতাল জীবন নিয়ে লেখা রিজিয়া রহমানের ‘একাল চিরকাল’ এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। এ উপন্যাস ধারণ করেছে সাঁওতাল জনপদের সুদীর্ঘকাল, এবং এখানে আছে সাঁওতালদের আনন্দ, বেদনা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, শোষণ, বঞ্চনা এবং ঈর্ষা আর স্বার্থপরতার ছবি।
আদিম জনপদের এই বিপর্যয়েরই শিল্পরূপ ‘একাল চিরকাল’। ভাষার ক্ল্যাসিক সংহতি, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ইতিহাসনিষ্ঠা, সমাজ সচেতনতা এবং শৈল্পিক সতর্কতা- সবকিছুর অন্তর্মিলনে রিজিয়া রহমানের এ উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের এক বিশিষ্ট সম্পদ।
লেখালেখির স্বীকৃতি হিসাবে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন রিজিয়া রহমান। ১৯৭৫ সালে ‘অনন্যা’ সাহিত্য পুরস্কারটি ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কার। এরপর ১৯৭৮ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে লাভ করেন যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার। হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮৪ সালে। আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার গ্রহণ করেন ১৯৮৪ সালে। এরপর ১৯৮৫ সালে লাভ করেন বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পদক এবং ১৯৯০ সালে তাঁকে দেওয়া হয় কমর মুশতারি সাহিত্য পদক।
লেখালেখির বাইরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন রিজিয়া রহমান। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর স্বজন, পরিজন। সেই সুবাদে ঘুরে বেরিয়েছেন লন্ডন, ফ্রান্স, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ভারতের দিল্লি ও উত্তর আমেরিকা।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
গল্প : অগ্নিস্বাক্ষরা (১৯৬৭), নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮)
উপন্যাস : ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪), উত্তর পুরুষ (১৯৭৭), রক্তের অক্ষর (১৯৭৮), বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), অরণ্যের কাছে (১৯৭৯), শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০), অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০), ধবল জোত্স্না (১৯৮১), সূর্য সবুজ রক্ত (১৯৮১), একাল চিরকাল (১৯৮৪), হে মানব মানবী (১৯৮৯), হারুন ফেরেনি (১৯৯৪)।
অনুবাদ সাহিত্য : সোনালী গরাদ (১৯৯৫)।
রিজিয়া রহমান ১৯৩৯ সালের আজকের দিনে (২৮ ডিসেম্বর) কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব