Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

0

বাবলু ভট্টাচার্য:

১৯৪৩ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ এর দিকে। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী মোড়লদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ ভারতবর্ষে। রাস্তায় তখন কংকালসার মানুষ ও কুকুর একই কাতারে। অনাহারে মৃত মায়ের স্তন পান করছে শিশু। ডাস্টবিন এ কুকুর। কাক আর মানুষের উচ্ছিষ্টের জন্য মারামারি। কোথা থেকে যেন শকুন, কাক দুর্ভিক্ষে মৃত প্রাণীর দেহ ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে কলকাতার রাস্তায়।

উনত্রিশ বছর বয়সের আর্ট স্কুলের এক শিক্ষক এসব দেখে শিউরে উঠেন। ডুকরে কেঁদে  উঠে তার মন। গলায় বোর্ড ঝুলিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে সেসবের ছবি আঁকেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে।

মানবদরদী এই মানুষটি ‘শিল্পাচার্য’ নামে খ্যাত জয়নুল আবেদিন।

১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার গণআন্দোলন হয়েছিল। তখন এ দেশের চিত্রশিল্পীরাও জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন এবং ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আর্ট কলেজে ‘নবান্ন’ শীর্ষক এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আপাদমস্তক এক বাঙালি জাতীয়তাবাদী জয়নুল, বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

‘সোনার বাংলা’ ও সুখ ও শান্তির দিনের চিত্র দিয়ে শুরু, তারপর ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাংলার ক্রম-নিঃস্বতার পরিণতি, চরম দারিদ্রবস্থা, দুর্ভিক্ষ এবং অবধারিতভাবে দুঃখী-দরিদ্র মানুষের গ্রামত্যাগী হয়ে শহরমুখী যাত্রা। এ এক মহা আলেখ্য। স্পর্শকাতর দৃশ্যাবলি, হৃদয়স্পর্শী উপস্থাপনা, অত্যন্ত সহজ সরল আঙ্গিক অথচ অসাধারণ তাঁর আবেদন।

১৯৭০ এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৩ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায় তিনি ব্যথিত হৃদয়ে আঁকেন মনপুরা ৭০ নামের ছবিটি। এতে দেখানো হয়েছে স্তূপীকৃত লাশের দৃশ্য, ‘আমরা শুধু মৃত্যুতেই একতাবদ্ধ হই’— এ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে জয়নুল দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়তেন।

তাঁর অন্যান্য শিল্পকর্ম গুলির মধ্যে- ‘পাইন্যার মা’, ‘পল্লী রমণী’, ‘আয়না নিয়ে বধূ’, ‘একাকী বনে’, ‘মা ও শিশু’, ‘তিন পল্লী রমণী’, ‘গুণ টানা’, ‘মুখ চতুষ্টয়’, বিদ্রোহী, সাঁওতাল রমণী, কাক ইত্যাদি অন্যতম। ১৯৭১ সালে এদেশে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হলে জয়নুল সেসব নিয়েও বিভিন্ন চিত্রকর্ম তৈরি করেন।

একজন বড়মানুষের সামাজের প্রতি দায়বোধ যেন সবচেয়ে বেশী। তিনি বলতেন- ‘আমি নিজে শিল্পকর্ম করে যতটা আনন্দ পাই তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে’। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে শিল্পের প্রতি অনুরক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

১৯৫১ সালে এটি সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট শাহবাগে স্থানান্তর করার পর ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণীর সরকারি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে।

তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর এই সরকারি কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। যা আজ চারুকলা অনুষদ নামে পরিচিত। এছাড়াও জয়নুল আবেদিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন।

তার জীবনে পাওয়া অসংখ্য পুরস্কার পদকের মাঝে আইয়ুব খানের দেয়া সরকারী খেতাব হিলাল-ই-ইমতিয়াজ তিনি বর্জন করেন বাঙালির উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচারের প্রতিবাদ ও তাদের প্রতি ঘৃণা স্বরূপ।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৯১৪ সালের আজকের দিনে (২৯ ডিসেম্বর) কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.