Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণ : আহসান হাবীব

0

বাবলু ভট্টাচার্য :

ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়র এবং ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়টের প্রবর্তনায় যে আধুনিকতার উদ্বোধন বাংলা কবিতায় ঘটেছিলো তিরিশের কবিদের রচনাকর্মে তারই যথার্থ উত্তরপুরুষ বাংলাদেশের কবি আহসান হাবীব।

আহসান হাবীব তাঁর অস্তিত্বের মৌল সংকট ও সংশয়- বেদনাকে নিজের আবেগ-অনুভূতি- সংবেদনা সহযোগে ফলিয়ে তোলেন তাঁর রচিত কবিতায়। আসলে অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও উপলব্ধির সারাৎসারই কবিতার মূল বিষয়। আহসান হাবীবের কবিতার বিষয়ও তাই।

আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ বেরোয় ১৯৪৭-এ এবং এ কাব্যেই সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিশ-শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন।

আহসান হাবীব তাঁর রচনায় ব্যক্ত করেন প্রবল আশাবাদ। কবিতায় স্বদেশলগ্নতা ও পুনঃমানবিকীকরণের উদ্বোধন ঘটান তিনি। এই অর্থে আধুনিক কবিতার বক্তব্যের ভুবনকে তিনি বহুদূর সম্প্রসারিত করেছেন।

জীবনঘনিষ্ঠ, সমাজচেতন ও স্বদেশলগ্ন অজস্র কবিতা লিখেছেন এই কবি। নাগরিক আবহাওয়ায় বিশ শতকীয় রোদ পোহালেও তাঁর গায়ে লেগে আছে পচা পাট, কচুরিপানা ও ডানকানা মাছের আঁশটে গন্ধ, পায়ে লেপ্টে আছে শিশিরসিক্ত কাদা।

তিনি যে চল্লিশের সমাজচেতনার যুগধর্মকেই আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন এর প্রমাণ মেলে তার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থে (১৯৮৫) উপস্থাপিত বক্তব্যে : ‘শ্রেণীবৈষম্যের অভিশাপ, মধ্যবিত্ত জীবনের কৃত্রিমতা এবং উদভ্রান্ত উদ্বাস্তু যৌবনের যন্ত্রণা আজো পর্যন্ত আমার কবিতার বিষয়বস্তু।’

চল্লিশের দশক ছিল নানামুখী আন্দোলনে মুখর। ঔপনিবেশিক শক্তির অত্যাচার এবং তার রক্তাক্ত প্রতিফলন ছিল একদিকে, অন্যদিকে ছিল সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন। ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নানামুখি অভিঘাত এবং স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তির তীব্র আকাঙক্ষার প্রকাশ। এই আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কালগত চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে আহসান হাবীবের কবিতা।

আহসান হাবীব বেড়ে উঠেছেন প্রথম মহাযুদ্ধ- পরবর্তী অস্থির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিসরে। যৌবনে প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। দুই-দুটি মহাযুদ্ধের অভিঘাত তাঁর মনন চৈতন্যে সংবেদনশীল কবিদের মতোই ছাপ ফেলেছে। সময়-সংকটে মুহ্যমান মানবজীবনকে তিনি কবিতায় রূপ দিয়েছেন। ‘সমকাল’ ও ‘সময়’ তাঁর রচনায় বিচিত্র অবয়বে ধরা দিয়েছে। তিনি লিখেছেন : ‘সময়ের পদধ্বনি আমাদের পুরোভাগে’।

আহসান হাবীবের কবিতায় জীবন ও গতির প্রতীক হয়ে আসে নদী, মিছিল এবং জোয়ার। ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাবো’ কাব্যে আহসান হাবীবের কাব্যদর্শন যেমন মানবিক সমগ্রতাবোধে স্পন্দিত, তেমনি প্রচণ্ড আশাবাদও ব্যক্ত হয়েছে এখানে : ‘আমি এই পথ থেকে ফিরবো না, কেননা,/ মানুষকে কোথাও না কোথাও যেতেই হয়/ অকাল সমৃদ্ধ এক সুস্থির আবাস তাকে/ অবশ্যই গড়ে নিতে হয়/ কোনোখানে’।

আহসান হাবীবের শেষ পর্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’ সময়-সমকাল-জীবন ও স্বদেশ চিন্তার শিল্পসফল সমন্বয়ে ঋদ্ধ। জীবনের সঙ্গে তিনি লেপ্টে থাকেন মাছির মতো। মানব সভ্যতার বহমান ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে তিনি সংলগ্ন করেন। তাঁর পক্ষে এ-জন্যেই খুব সহজে আবহমান মানবজীবনের বেদনা-আনন্দ-অভিলাষ ও বিষাদের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করা সহজ হয়ে ওঠে।

বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক এবং ১৯৯৪ সালে মরণোত্তর দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।

১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই আহসান হাবীব মৃত্যুবরণ করেন।

আহসান হাবীব ১৯১৭ সালের আজকের দিনে (২ জানুয়ারি) পিরোজপুরের শংকরপাশায় জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.