বাবলু ভট্টাচার্য :
ছোটবেলার স্কুল পাঠ্যে ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল/ কাননে কুসমকলি সকলি ফুটিল’ এ কবিতা পড়েননি এমন বাঙালি হাতে গোনা। এখনও কেউ কেউ চেষ্টা করলে কবিতার দু’এক ছত্র মনে করতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালিই জানেন না বাংলা শিশু সাহিত্যের সার্থক ওই কবিতার কবির নাম।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়ার গোড়াপত্তন হয়েছিল যাঁর বই পড়ে সেই ‘প্রভাত বর্ণনের’ কবি বিদ্যাসাগরের বন্ধু ও বাংলার নারীশিক্ষার প্রচার ও প্রসারের পুরোধা পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার।
মদনমোহনের বাবা রামধন চট্টোপাধ্যায় এবং মা বিশ্বেশ্বরী দেবী। সংস্কৃত কলেজের লিপিকর বাবা ‘বিদ্যারত্ন’ উপাধি পেয়েছিলেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মদনমোহন ছিলেন সবার বড়।
১৮২৯ সালে সংস্কৃত কলেজে পড়তে গিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ইয়ং বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা ডিরোজিওর উদ্যোগে সে সময়ে দেশ জুড়ে চলছে কুসংস্কার, নানা সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ও ইংরেজি স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের জন্য আন্দোলন। ইয়ংবেঙ্গলের অন্যতম সদস্য রামতনু লাহিড়ীর বাড়িতে থাকার সুবাদে মদনমোহনও সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর থেকে ১৮৫৮ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মদনমোহন শিক্ষা এবং সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত থাকেন।
১৮৪২ সালে হিন্দু কলেজের পাঠশালার প্রধান শিক্ষক হিসাবে মদনমোহন কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর ১৮৪৬ সালে নদীয়ার রাজা শ্রীশচন্দ্র কৃষ্ণনগরে কলেজ স্থাপন করলে তিনি সেখানে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। ১৮৪৬ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৮৫০-৫৪ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের জজ পণ্ডিত। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে নির্মাণেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
জীবনের শেষ পর্বে প্রশাসক হিসেবেও তিনি বেশ কিছু সংস্কারে হাত দেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মুর্শিদাবাদ এবং কান্দিতে দাতব্য চিকিৎসালয়, মেয়েদের স্কুল, রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন। সেকালে শিক্ষা সংস্কারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেব যখন এদেশের মেয়েদের জন্য ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ স্থাপনে মদননোহন ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। বিনা বেতনে তিনি ওই স্কুলে পড়াতেন। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর দুই মেয়ে ভুবনমালা এবং কুন্দমালাকে ওই স্কুলে ভর্তি করেন।
শিশুদের জন্য লেখেন ‘শিশু শিক্ষা’ নামে একটি বই। যে বই দিয়ে শৈশবে রবীন্দ্রনাথের লেখাপড়া শুরু হয়েছিল। রবিজীবনীতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। “রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা আরম্ভ হয়েছিল মদনমোহনকৃত শিশুশিক্ষা দিয়ে এবং তারপরে সম্ভবত বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল।”
১৮৪৯ সালে লেখা শিশুশিক্ষার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগ ১৮৫০ এর মধ্যে তাঁর লেখা হয়ে গিয়েছিল। বলা হয় বইটি ছিল বাঙলার প্রথম “প্রাইমার”। এর ঠিক পরেই তিনি লেখেন ‘স্ত্রীশিক্ষা’ নামে এর একটি বই। যেখানে তিনিই প্রথম বলেছিলেন শিশুকে শিক্ষিত করতে গেলে মায়েরই শিক্ষা আগে দরকার।
‘রসতরঙ্গিনী’ এবং ‘বাসবদত্তা’ তাঁর মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবি প্রতিভার জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ‘কাব্য-রত্নাকর’ এবং পান্ডিত্যের জন্য ‘তর্কালঙ্কার’ উপাধি লাভ করেন।
১৮৫৮ সালের ৯ মার্চ দুরারোগ্য কলেরায় মদনমোহন তর্কালঙ্কার মারা যান।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার ১৮১৭ সালের আজকের দিনে (৩ জানুয়ারি) নদীয়ার নাকাশিপাড়ার বিল্বগ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব