Take a fresh look at your lifestyle.

২০ বছর পেটে অস্ত্রপচারের কাঁচি

0

প্রতিনিধি, মেহেরপুর :

গাংনীর রাজা ক্লিনিকে অপারেশনের দীর্ঘ ২০ বছর পর রোগীর পেটে মিলেছে কাঁচি (স্টিলের লিডিল হোল্ডার)। অভাবি বাচেনা খাতুন সহায় সম্বল বিক্রি করে মেহেরপুরের গাংনীর রাজা ক্লিনিকে পিত্তথলির পাথর অপারেশন করেছিলেন । কিন্তু তারপরও সুস্থ হতে পারেননি তিনি। এত বছর পেটের ব্যথার অসহ্য যন্ত্রণা নিরাময়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ছুটেছেন। চিকিৎসা নিয়েছেন বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে। খুইয়েছেন অর্থ সম্পদ। অবশেষে ২০ বছর পর তার পেটে মিলল অপারেশনকালে ডাক্তারের রেখে দেয়া লিডিল হোল্ডার (কাঁচি)। অপারেশনের সময় পেটের মধ্যে কাঁচি রেখেই পেটের কাটা ছেড়া জোড়া দিয়েছিলেন চিকিৎসক। বাচেনা খাতুন পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার আবদুল হামিদের স্ত্রী।

চিকিৎসকের রেখে দেয়া অপারেশনে ব্যবহৃত লিডিল হোল্ডারের (কাঁচির) ভারে অসুস্থ বাচেনা খাতুনের ২০টি বছরকে করেছেন দুর্বিসহ। হতে হয়েছে নিঃস্ব। চিকিৎসকের ভুলে দীর্ঘ কুড়ি বছর সয়েছেন পেটের ব্যথা। চিকিৎসা প্রদানসহ ক্ষতিপূরণের দাবিও করেন বাচেনা খাতুনের পরিবার। তবে ক্লিনিক মালিক বলছেন, বাচেনা খাতুনের পুনঃচিকিৎসার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হবে।

২০০২ সালে মেহেরপুরের গাংনীর ‘রাজা ক্লিনিকে’ চিকিৎসা নিতে আসেন আলমডাঙ্গার হাপানিয়া গ্রামের আব্দুল হামিদের স্ত্রী বাচেনা খাতুন। রাজা ক্লিনিকের পরিচালক ডাঃ পারভিয়াস হোসেন রাজার শরনাপন্ন হলে বাচেনা খাতুনকে পিত্তথলির পাথর অপারেশন করার পরামর্শ দেন। বাচেনা খাতুনকে সুস্থ্ করতে অপারেশনের চুক্তি করেন বাচেনা খাতুনের পরিবার। ওষুধপত্র ও অপারেশন ফি বাবদ ২০ হাজার টাকায় চুক্তি করেন ক্লিনিক মালিক পারভিয়াস হোসেন রাজা।

স্ত্রীর অপারেশনের জন্য একমাত্র সম্বল ১০ কাঠা জমি বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন । ২৫ মার্চ ২০০২ বাচেনা খাতুনের অপারেশন করেন মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের তৎকালীন সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মিজানুর রহমান। তার সাথে সহকারি হিসেবে ছিলেন রাজা ক্লিনিকের পরিচালক ডা. পারভিয়াস হোসেন রাজা ও অ্যানেস্থেসিয়া করেন ডা. তাপস কুমার।

অপারেশনের এক সপ্তাহ পর বাচেনা খাতুনকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছাড়পত্র দেন। অপারেশন করানো হলেও বাচেনা খাতুনের অসুস্থতা দিনদিন বাড়তেই থাকে। ফের ডা. রাজার শরনাপন্ন হলে ঠিক হয়ে যাবার কথা বলে ফেরৎ পাঠান। পেটের ব্যথায় অবশেষে দ্বিতীয়বার ডা. রাজার সাথে দেখা করেও কোন লাভ হয়নি। সুস্থতার জন্য বিভিন্ন এলাকার চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেন বাচেনা খাতুন। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা নিতে বিক্রি করতে হয় শেষ সম্বল হালের দুটি গরু। বাচেনার পেটের তীব্র যন্ত্রনার আত্মচিৎকারে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। প্রতিবেশিরাও অনেক সয়য় বাচেনার বাড়িতে ছুটে আসেন। সহায়তার হাত বাড়ান। কয়েকদিন আগে স্থানীয়দের পরামর্শে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের নিউরোমেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজা নাসিমের কাছে যান। ওই চিকিৎসক বাচেনা খাতুনকে এক্স-রে করেন। এক্স-রে রিপোর্টে পেটের মধ্যে ৪-৫ ইঞ্চি’র একটি কাঁচির সন্ধান মেলে। কুড়ি বছর পর পেটের মধ্যে কাঁচির সন্ধান পাওয়ায় হতাশ ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বাচেনা খাতুন। এমন খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে বাচেনা খাতুনের বাড়িতে ভিড় জমায় এলাকার মানুষ। ছুটে আসেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও।

কান্নাজড়িত কন্ঠে বাচেনা খাতুন বলেন, আমি ২০ বছর আগে গাংনীর রাজা ক্লিনিকে পিত্তথলির পাথর অপারেশন করি। অপারেশনের পর দুটি পাথর আমাদের হাতে দিয়েছিলেন ডা. রাজা। অপরেশন করলে সুস্থ হওয়ার কথা দিয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু আমার পেটের যন্ত্রনা দিনদিন বাড়তেই থাকে। কয়েকবার আমার সমস্যার কথা জানাতে গিয়েও প্রতিকার মেলেনি। অনেক জায়গায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায় সম্বল শেষ হয়ে আমি এখন নিঃস্ব। আমার স্বামী একজন প্রতিবন্ধী। শ্রম বিক্রি করে যে টাকা রোজগার করে তা দিয়ে কোনরকমে সংসার চলে। এর পরও আমার চিকিৎসার টাকা ছিলনা। মাত্র ১০ কাঠা জমি ছিল তাও বিক্রি করে দিয়েছি। পরে হালের দুটি গরু বিক্রি করেও আমার জন্য খরচ করতে হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রনায় আমি ছটফট করি। আমার চিৎকারে প্রতিবেশিরাও ছুটে আসে। গত শনিবার রাজশাহীতে গিয়ে আমার পেটের মধ্যে একটি কাঁচি আছে বলে ছবিতে দেখতে পাই। যারা আমার অপারেশনের সময় ভুল করেছে আমি ক্ষতিপুরণসহ বিচার চাই।

বাচেনার স্বামী আব্দুল হামিদ বলেন, আমি একজন প্রতিবন্ধী। আমার একটি পা অচল। কেউ আমাকে কাজে নেয় না। আমি এখন কি করব তা ভেবে রাতে ঘুমাতে পারছিনা। গত শনিবারে আমার স্ত্রীকে রাজশাহীতে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে স্ত্রীর পেটের মধ্যে কাঁচি মিলেছে। আমি আবার কি দিয়ে তার অপারেশন করাবো। আমার আর কিছুই নাই। কার কাছে গেলে সহযোগিতা পাব তাও জানিনা। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।

প্রতিবেশী আফরোজ খাতুন বলেন, প্রতি রাতে বাচেনার চিৎকারে আমরা অতিষ্ট হয়ে যাই। অনেক সময় তার কান্নায় আমাদেরও চোখে পানি আসে। অনেক টাকা খরচ করেও যদি ডাক্তার এমন ভুল করেন তাহলে আমরা কোথায় যাব? এই নিঃস্ব বাচেনার চিকিৎসার সব দায়িত্ব ও ক্ষতিপূরণের দাবি করছি।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সুজন আলী বলেন, সহায় সম্বল বিক্রি করেও যখন হয়নি তখন বাচেনার চিকিৎসার জন্য গ্রামের অনেক মানুষ তাকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছে। এখন জানতে পারলাম বাচেনার পেটের মধ্যে একটি কাাঁচি রেখেই সেলাই দিয়েছে ডাক্তার। ডাক্তারের এমন ভুলে বাচেনার পরিবার শুধু নিঃস্বই হয়নি, জীবনও বিপন্ন হতে চলেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে ডাক্তারের কাছে আমি বিষয়টি জানাবো, যদি তিনি এর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না করেন তবে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রাজা ক্লিনিকের সত্বাধিকারী ডা. পারভিয়াস হোসেন রাজা বলেন, আমি বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারিনা। আমিও ওই অপারেশনের সময় সহকারি হিসেবে ছিলাম। মানুষ মাত্রই ভুল হতে পারে। তার পরেও ডা. মিজানুর রহমান সার্জারি বিভাগের ভালো ডাক্তার ছিলেন। তিনি ওই সময় মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে চাকরি করতেন। তখন আমার ক্লিনিকে সব অপারেশনই তিনি করতেন। তিনিই ভুলটা করতে পারেন। তবে তার পরিচয় জানিনা। মেহেরপুরে চাকরির সুবাদে তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। হয়তোবা এটি তার অনাকাংখিত ভুল। তবুও ২০ বছর বাচেনাকে কষ্ট পেতে হয়েছে। ওই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তার সব দায়িত্ব আমি নেব।

অপাবেশনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মিজানুর রহমানের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। তিনি ২০০১ সালে মেহেরপুর জেনারেল হাসাপাতালে কর্মরত ছিলেন। এখন তিনি অবসর নিয়ে নিজ এলাকা খুলনাতে আছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
মেহেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. জওয়াহেরুল আনাম সিদ্দিকী জানান, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.