বাবলু ভট্টাচার্য :
চিন্তাচেতনায় মহান দার্শনিক সক্রেটিসের ভাবশিষ্য ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেব। যিনি ডক্টর জিসি দেব নামে সমধিক পরিচিত। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দার্শনিক দেব সব ধর্মকে দেখেছেন উদার ও সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে।
দেব ১৯২৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বি.এ (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম.এ ডিগ্রি লাভ করে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ‘রিজন, ইনটুইশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’ নামক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।
দেব এই উপমহাদেশে সমন্বয়ী দার্শনিক ধারার সার্থক প্রবর্তক। তাঁর দর্শনের স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি ভাববাদকে সমন্বয়ী ভাববাদ হিসেবে উল্লেখ করে একে চিরায়ত ভাববাদ থেকে পৃথক করেছেন এবং একে প্রগতির ধারক ও বাহক বলে মনে করেছেন। তিনি শুধু তত্ত্বসর্বস্ব দর্শন আলোচনা করেননি, তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
দেবের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট নয়টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস (১৯৫২), আইডিয়ালিজম: এ নিউ ডিফেন্স অ্যান্ড এ নিউ এ্যাপলিকেশন (১৯৫৮), আমার জীবনদর্শন (১৩৬৭), এ্যাসপিরেশন অব দ্য কমন ম্যান (১৯৬৩), দি ফিলোসফি অব বিবেকানন্দ অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব ম্যান (১৯৬৩), তত্ত্ববিদ্যাসার (১৯৬৬), বুদ্ধ: দ্য হিউম্যানিস্ট (১৯৬৯)। এছাড়া দেশিবিদেশি পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় দেবের প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে দেবকে সম্মানসূচক ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছর তাঁর মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য আমেরিকায় ‘দ্য গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে গোবিন্দদেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করে।
মানবকল্যাণ সাধনায়, সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য চিরকুমার দেব তাঁর সব সম্পত্তি ও অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
গোবিন্দচন্দ্র দেব ১৯০৭ সালের আজকের দিনে (১ ফেব্রুয়ারি) সিলেট জেলার বিয়ানীবাজারের লাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব