Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ শহীদুল্লা কায়সার

0

বাবলু ভট্টাচার্য:

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বসে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন সেই কালজয়ী উপন্যাস ‘সারেং বউ’। যার জন্য পেয়েছিলেন ‘আদমজী পুরস্কার’। বলেছিলেন- ‘আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠিয়েছে, আর আমি হয়ে উঠেছি সাহিত্যিক’।

হ্যাঁ, বাংলাদেশের সেই কিংবদন্তী সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সারের কথা বলছি। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা।

তার পিতার নাম মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ্ এবং মাতার নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন৷ শিক্ষাজীবনের শুরুতে সরকারি মডেল স্কুলে এবং পরে ‘মাদরাসা-ই-আলিয়া’র অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য তিনি ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে৷

১৯৪৬ সালে তিনি সেখান থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন এবং অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কিন্তু শেষ করেননি৷ একই সাথে তিনি ‘রিপন কলেজে’ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজ) আইন বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন৷

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তার বাবা ঢাকায় চলে আসেন এবং শহীদুল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। তবে এ ডিগ্রি লাভ করার আগেই লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটান।

শহীদুল্লা কায়সার সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ও ১৯৫১ সালে পার্টির সদস্য হন। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি দেশপ্রেমিক ছদ্মনামে রাজনৈতিক পরিক্রমা ও বিশ্বকর্মা ছদ্মনামে বিচিত্রা কথা শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় রচনা করেছেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন এবং ভাষা আন্দোলনে তার রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালের ৩ জুন তিনি গ্রেফতার হন। এ সময় তাকে সাড়ে তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই পুনরায় গ্রেফতার হন। কয়েক বছর পর মুক্তি পান। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়৷ জননিরাপত্তা আইনে তাকে এ পর্যায়ে ১৯৬২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আটক রাখা হয়৷

‘সংবাদ’ পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার। এই পত্রিকার অফিস ভস্মীভূত হওয়ার পর তাঁর ডাক আসে ভারতে যাবার। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বার বার লোক আসে তাঁকে নিয়ে যেতে। এরপর কমরেড মণি সিংহ ‘আর এখানে থাকা উচিৎ নয়’- এ কথা জানিয়ে তাঁর কাছে পত্র লেখেন এবং লাল কালিতে তা আন্ডারলাইন করে দেন। রাশিয়ান দূতাবাসও বার বার তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু শহীদুল্লা কায়সার দেশ ছেড়ে যাননি। কারণ তিনি ভাবেন সবাই দেশ ছেড়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে কে?

১৩ ডিসেম্বর তিনি পরিবারের চাপে নিরাপত্তার জন্য বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। তবে ঢাকাতেই কোথাও আত্নগোপনে থাকবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু বাড়ি ছাড়ার আধঘন্টা পর আবার ফিরে আসেন। মাকে বললেন- ‘আমি একা থাকবো না। তোমাদের নিয়ে একসাথে থাকবো!’

১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা। পুরানো ঢাকার কায়েতটুলির বাড়িতে শহীদুল্লা কায়সার মোমবাতি জ্বালিয়ে বিবিসি শোনার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। তাঁর ছোট ভাই ওবায়দুল্লা এসে বললেন- ‘বড়দা দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে, খুলে দেবো?’ তিনি বলে উঠলেন- ‘মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দাও।’ একথা বলে তিনি আলমারি খুলে টাকা বের করলেন মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেবার জন্য।

চার-পাঁচজন লোক কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে ঘরে প্রবেশ করেই জিজ্ঞাসা করল- ‘শহীদুল্লা কায়সার কে?’ শহীদুল্লা কায়সার এগিয়ে এসে বললেন- ‘আমিই শহীদুল্লা কায়সার।’ সেই কাল কাপড়ে মুখ ঢাকা লোকগুলি তাঁর হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল।

স্ত্রী পান্না কায়সার ছুটে এসে স্বামীর হাত চেপে ধরলেন। অন্য ঘর থেকে শহীদুল্লা কায়সারের বোন ছুটে এসে ভাইয়ের হাতটি চেপে ধরলেন। কিন্তু তাঁরা শত শক্তি প্রয়োগ করেও ধরে রাখতে পারলেন না স্বামী ও ভাইকে।

কারফিউ-এর অন্ধকারে তিনি চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলেন। তাঁর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর মৃতদেহও না!

শহীদুল্লা কায়সার ১৯২৭ সালের আজকের দিনে (১৬ ফেব্রু) ফেনী জেলার মাজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

-লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.