Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ পপগুরু আজম খান

0

বাবলু ভট্টাচার্য :

মায়াময় দৃষ্টির প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন না বলা এক একটি কবিতা। কাব্যের হাত ধরে সুরের বর্ণ পরিচয়। বন্দুক ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেক আগেই। পিতৃআজ্ঞা পালন করে দেশকে মুক্ত করতে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অধ্যায়ও কবেই চুকেবুকে গেছে। হাতের ‘গান’ (Gun) ফেলে দিলেও কণ্ঠের গানতো আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। হয়ে গেলেন যোদ্ধা থেকে গানের বোদ্ধা। রণাঙ্গন ছেড়ে একেবারে সঙ্গীতাঙ্গনে। সেই থেকে কোটি মানুষের অন্তরে মিশে যাওয়া এক নাম, আজম খান।

খুব সাদামাটা গোছের দেখতে, লিকলিকে দীর্ঘদেহী যুবকটি। লম্বা চুলে সারল্য মাখা চাহনি। কিন্তু চাল-চলনে ব্যক্তিত্বের ছাপ ষোলোআনা। বয়স তখন আঠারো ছুঁই ছুঁই। গান বাজনা নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসেন সব সময়। কখনো মনে হয়নি এই ছেলের বুকেও জ্বলছে পরাধীনতার লেলিহান শিখা।

যুক্ত হলেন গণশিল্পীগোষ্ঠী ‘ক্রান্তি’র সাথে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগীতের মাধ্যমে নতুন জোয়ার তোলার চেষ্টায় রত হলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শুরু হলে নিজেকে আর ঘরে বেঁধে রাখতে পারেননি তিনি।

বাড়ি থেকে বিদায় বলে রওনা দেয়া, বন্ধুদের নিয়ে হাঁটা পথে কুমিল্লা বর্ডার দিয়ে আগরতলা পৌঁছানো, সেখান থেকে মেঘালয়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে দু’মাস গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়া— সবই যেন একটা ঘোরের মধ্যেই হচ্ছিল।

কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধের সাফল্যের পর তাঁকে একটা সেকশনের ইন-চার্জ করে ঢাকায় পাঠানো হয় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য। যাত্রাবাড়ী-গুলশান এলাকায় গেরিলা তাণ্ডবে পুরো পাকিস্তানি বাহিনীর ঘুম উধাও করে দিয়েছিল আজম খানের দল। তার হাত ধরেই এলো ‘অপারেশান তিতাস’। ঢাকা শহরের গ্যাস পাইপলাইন নষ্ট করে দিয়ে বিদেশীদের জানান দেয়া যে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, এটাই ছিল এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য।

অবশেষে এলো সেই বহুল প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। কিন্তু প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সেতুবন্ধন মনের মতো হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ তখনও যেন অপেক্ষা করছিল আরেকটি সংগ্রামের। সেটি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি ও শিল্প সংস্কৃতির শক্তিশালী অবস্থান অর্জনের সংগ্রাম। দিশাহীন পথের গন্তব্য খোঁজার চেষ্টায় পাশে পেলেন ‘আখন্দ’ ভাতৃদ্বয়কে- হ্যাপি আখন্দ এবং লাকী আখন্দ, গড়ে তুললেন ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’। ব্যান্ড স্পন্দনের পর এটি ছিল বাংলা নামে স্বাধীন দেশের দ্বিতীয় ব্যান্ড। গিটারে থাকলেন আজম খানের বন্ধু নিলু আর মনসুর, ড্রামে সাদেক আর নিজে রইলেন প্রধান ভোকাল হিসেবে।

হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিক। এ যেন এক নতুন জাগরণ। হাজার মানুষের মনের কথা যেন ফুটে উঠছে তার কণ্ঠে। শুরু হলো বাংলায় পপ গানের বিস্তার। তারই হাত ধরে ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের গানের জগতে আসা। ধীরে ধীরে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করে পপ সম্রাট হয়ে উঠলেন সঙ্গীতের মহাগুরু আজম খান।

তার পুরো নাম ছিল মাহবুবুল হক খান। বাবা মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট, মা জোবেদা খাতুন। তার ছিল তিন ভাই ও এক বোন।

পড়ালেখা শুরু হয় ১৯৫৫ সালে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে। ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ১৯৭০ সালে টিঅ্যান্ডটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের জাগরণ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে পড়ালেখা আর এগোয়নি তার।

১৯৮২ সালে ‘এক যুগ’ নামের এ্যালবাম দিয়ে অডিও জগতে আত্মপ্রকাশ করেন আজম খান। এরপর থেকে নিয়মিত বিরতিতে মোট ১৭টি একক এ্যালবাম করেন। তার উল্লেখযোগ্য এ্যালবামগুলোর মধ্যে আছে দিদি মা, বাংলাদেশ, কেউ নাই আমার, অনামিকা, কিছু চাওয়া, নীল নয়না ইত্যাদি।

সঙ্গীত ছাড়াও মিডিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৮৬ সালে ‘কালা বাউল’ নামে একটি নাটকে কালা বাউলের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও ২০০৩ সালে ‘গডফাদার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এছাড়াও বিজ্ঞাপন জগতে তিনি পদার্পণ করেন ২০০৩ সালে ক্রাউন এনার্জি ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। পরবর্তিতে বাংলালিংক ও কোবরা ড্রিংকসের বিজ্ঞাপনেও কাজ করেন তিনি।

গানের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলেছেন আজম খান। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন।

তাঁর বর্ণাঢ্য সঙ্গীত জীবনে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন, যার মধ্যে : হলিউড থেকে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে ‘বেস্ট পপ সিংগার অ্যাওয়ার্ড’, ‘টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২’, ‘কোকাকোলা গোল্ড বটল’ সহ ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ অন্যতম।

সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে তাঁকে মরণোত্তর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।

২০১১ সালের ৫ জুন অসংখ্য গানপাগল ভক্তদের কাঁদিয়ে তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে।
আজম খান ১৯৫০ সালের আজকের দিনে (২৮ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার আজিমপুরের দশ নম্বর কোয়ার্টারে জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.