Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণ : শাফী ইমাম রুমী

0

বাবলু ভট্টাচার্য :

‘আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ কী বলেন, জানো? তিনি বলেন, “কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না; চায় রক্তাক্ত শহীদ।” অতএব মামনি, আমরা সবাই শহীদ হয়ে যাব, এই কথা ভেবে মনকে তৈরি করেই এসেছি।’

ইস্পাতসম এই কঠিন কথাগুলো যিনি তাঁর মাকে বলেছিলেন ১৯৭১ সালে, তিনি হলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান শহীদ শাফী ইমাম রুমী। যিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ রুমী ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্ণধার জননী জাহানারা ইমামের বড় সন্তান। বাবা শরীফ ইমাম ছিলেন একজন প্রকৌশলী। রুমীর ছোট ভাইয়ের নাম জামী।

রুমী শৈশব থেকেই ছিলেন ভীষণ মেধাবী। বয়সের তুলনায় তাঁর মানসিক বিকাশ ছিল একটু বেশি। এই ধরনের মানসিক অবস্থাকে বলা হয় ‘মেন্টালি অ্যাডভান্সড চাইল্ড’। তিনি বেড়ে ওঠেন সেই সময়ের স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত একটি পরিবেশে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। তাঁর মা ছিলেন তখনকার একজন খ্যাতিমান স্কুলশিক্ষিকা। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ের লেখিকা তাঁর মা।

আজিমপুরের কিন্ডারগার্টেন স্কুল দিয়ে শুরু হয় রুমীর লেখাপড়া। ১৯৬৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসির পাঠ শেষ করেন। লেখাপড়ায় ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ভীষণ মেধাবী। পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ড থেকে মেধাতালিকায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন।

রুমী শিশু বয়স থেকেই জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। মা জাহানারা ইমাম তাঁকে একটি বুকসেলফ কিনে দিয়েছিলেন, বই জমানোর জন্য। রুমী ছিলেন বইয়ের পোকা। পুরো বুকসেলফকে তাঁর লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেন। নামীদামি বইয়ের স্পর্শে তাঁর মেধা হয়ে ওঠে আগুনের পরশমনি।

রুমী ‘ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেনিং কার’-এ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যোগ দেন। এবং মেধার সঙ্গে সার্জেন্ট পদে পদোন্নতি পান। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডের এক বিরল প্রতিভা। ব্যবহার আর মনমানসিকতায় তিনি জয় করে ফেলেছিলেন সবার মন।

প্রকৌশলী বাবার মতো তিনিও চাইতেন বিখ্যাত প্রকৌশলী হতে। শৈশব থেকেই ছিলেন মেধাতে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন এবং অর্জন করেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বতর্মানে বুয়েট) মেধার স্থান।

আমেরিকার বিখ্যাত ইলিনয়স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে চান্স পান। কিন্তু সেখানে আর পড়তে যাওয়া হয়নি। নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে যোগ দেন মুক্তিবাহিনীতে।

আমেরিকার শিকাগোতে চান্স পাওয়ার পরও তিনি পড়তে যাননি। নিজের ভবিষ্যতের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাঁর কাছে দেশের ভবিষ্যৎ। যোগ দেন মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণে। প্রিয় সন্তানকে যেতে দিতে মন চাইছিল না মা জাহানারা ইমামের। কিন্তু সন্তানের প্রবল দেশপ্রেমের কাছে নতি স্বীকার করতে হলো তাঁকে। জননী জাহানারা ইমাম বাধ্য হয়ে সন্তানকে বললেন, ‘যাহ, তোকে দেশের জন্য কুরবানি করে দিলাম।’

জননী জাহানারা ইমাম বুঝে গিয়েছিলেন যে রুমী যুদ্ধে গেলে হয়তো আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। মায়ের মন যেন বুঝে গিয়েছিল সন্তানের বিপদের কথা।

আমেরিকার শিকাগোতে পড়তে যাওয়ার পরিবর্তে রুমী চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। ভীষণ আদর-যত্নে বড় হওয়া রুমী অর্ধাহারে-অনাহারে, বনেজঙ্গলে, ধুলাবালি কাদামাটি মেখে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিলেন।

রুমী যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন সেক্টর-২-এর অধীনে মেলাঘর ও আগরতলা থেকে। রুমী দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন ১৯৭১ সালে। খুব কম সময়ে তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে হয়ে ওঠেন ‘আদর্শ মুক্তিযোদ্ধা’।

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর বাসায় ছিলেন। তাঁর বাবা, ভাই ও তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। ভয়ানক অত্যাচার করে ছেড়ে দেয় রুমীর বাবা ও ভাইকে। দেহ ও মনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রুমীর বাবা প্রকৌশলী শরীফ ইমামের হৃদযন্ত্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

শাফি ইমাম রুমী ১৯৫১ সালের আজকের দিনে (২৯ মার্চ) ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.