‘২৪ ঘণ্টা পর যদি যশোরে থাকতে পারেন চুড়ি পরে ঘুরব’
প্রতিবেদক :
যশোর সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাজহারুল ইসলাম মাজহারের বিরুদ্ধে ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে হত্যার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। মুঠোফোনে হুমকির কথোপকথনের অডিও যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভুক্তভোগী ঐ প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম।
মুঠোফোনে হুমকির কথোপকথনের অডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীর পরিবার।
গত ৩১ ডিসেম্বর যশোর কোতয়ালী মডেল থানায় ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষকের করা জিডিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, যশোর সদর উপজেলার ইছালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগের কমিটির অগোচরে যুবলীগনেতা মাজহার ও তার সহযোগিতারা এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করেন। এতে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও অভিভাবকরা ঐ কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনাসহ একজন অভিভাবক হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে এই মামলাটি চলমান রয়েছে। গত ২৪ মার্চ দুপুর দুইটার দিকে মাজহার তার ০১৭১১৪৮৭৭১৯ নম্বর থেকে প্রধান শিক্ষককে ফোন দিয়ে কমিটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে বলেন। তাকে কমিটির বিষয়ে মামলা চলমান রেেয়ছে জানালে গালিগালাজসহ জীবননাশের হুমকি দেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ জিডির মাধ্যমে নিরাপত্তা চেয়ে তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। এদিকে, সোমবার রাতে যুবলীগনেতা মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামের মুঠোফোনে হুমকির কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। সোমবার রাত থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ওই কথোপকথনের অডিও। একটি শিক্ষককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ জীবননাশের হুমকি দেওয়ার সবশ্রেণী পেশার মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমানের রাজনীতিবিদ-কর্মীদের তাদের দলীয় আদর্শ-চেতনা নিয়ে।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিওতে শুনা যাচ্ছে, যুবলীগনেতা মাজহারুল বারবার অকথ্য ভাষায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামকে গালিগালাজ করতে। কথোপকথনের প্রথমেই যুবলীগনেতা প্রধান শিক্ষককে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে।
মাজহারুল : স্যার কোথায় আছেন?
প্রধান শিক্ষক: আমি অসুস্থ বাসায় আছি।
মাজহারুল : কমিটির আবেদন করবেন না আপনি?
প্রধান শিক্ষক: এখনো তো করেনি। আমি সুস্থ হয়ে নেই। দেখি কি করা যায়।
মাজহারুল : আমার এমপি সাহেব (যশোর-৩ আসনের সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ) আমারে পাঠিয়েছে। এখন আমি আপনার স্কুলের চেয়ারের সামনে বসে আছি। ফরিদ ভাই (সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহম্মেদ চৌধুরি) কালকে আপনার বাসায় লোক পাঠাতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি বলেছি আপনি অসুস্থ, তাই আসেনি। ফিঙ্গে লিটনের (যশোরের তালিকা ভুক্ত সন্ত্রাসী) গাঁজাখোঁর ইয়াবা খোঁর ছেলে-পেলে যেয়ে আপনার সাথে যদি খারাপ ব্যবহার করে। তা হলে পরবর্তীতে আমার ঘাড়েই আসে।
প্রধান শিক্ষক: না… খারাপ ব্যবহার করবে কেন।
মাজহারুল : আপনি আর কথা বলবেন না। আপনার কোন কথা জীবনে আর শুনবো না। আপনি কমিটির দরখাস্ত করবেন না, করবেন.. সেটা গতদিন আপনাকে জানিয়েছি। কালকে এসপির সাথে কথা হলো, হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কমিটি আপনার আরো তিনমাস পরে মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটি ইতোমধ্যে বের হয়ে গেছে। আপনি কার ক্ষমতায় এই কমিটির আবেদন করছেন না; সেটা আপনাকে বলতে হবে? আর যদি না করেন তা হলেও বলে দিতে হবে আমি এই কমিটির আবেদন করবো না। তার পরে আপনার সাথে বুঝবো পরে এই বিষয়ে।
প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার কথা শুনবা না কেন। তোমারে ফোন দিলেই তুমি কেটে দাও শুধু। আমার ফোনটা ধরতে হবে। আর কথাটা শুনতে হবে।
মাজহারুল : আচ্ছা বলেন বলেন ।
প্রধান শিক্ষক: আমি কি আবেদন করবো। যারা মামলা করেছে; তাদের সাথে তো আমার কথা বলা লাগবে না কি? মামলা তুলে দেওয়া লাগবে না?
মাজহারুল : ওরা মামলা তুলছে না কেন? উত্তেজিত কন্ঠে আপনি আমারে মামলা বুঝান। আমার এই অল্প বয়সে আমি ৫টা মার্ডার মামলা খেয়েছি। আপনি আইন শেখান। ঐ মামলার কাগজপত্র ৬ মাস পরে সব বাতিল হয়ে যাবে। আপনার কত বড় ক্ষমতা আপনি এমপি সাহেবের কথা শুনছেন না। সব মামলা আপনি করাচ্ছেন।
প্রধান শিক্ষক: না আমি করাতে যাবে কেন? মামলা তুলে না নিলে কমিটির আবেদন করা যাবে না তো। তাই সবার সাথে কথা বলতে হবে। আমি বলবো, তুমি বলবা।
মাজহারুল : শুনেন স্যার আমি কারোও সাথে কথা বলতে পারবো না। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কার সাথে কথা বলবেন না ; কি বলবেন আপনি জানেন। আপনার কোন মা বাপ (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) আছে তাদের সাথে কথা বলেন। ২৪ ঘন্টার মধ্যে কমিটি যদি আবেদন না করেন, তা হলে আপনি যদি যশোর থাকতে পারেন। তার পরে আমি চুরি পরে এই যশোরে ঘুরে বেড়াবো। (গণমাধ্যমে অপ্রকাশযোগ্য অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ) হত্যার হুমকি। আমি আপনার সাথে দুই বছর ভালো ব্যবহার করেছি। তোমার কিডা ঠেকাই আমি দেখবানে। তোর এতো বড় সাহস তুই কাজী নাবিল আহমেদের ডিও লেটারে মামলা করেছিস। তোর কিডা আছে। তুই আজকের পর থেকে নীলগঞ্জে কিভাবে থাকিস দেখবানে। তোর লোকজন পুলিশ-র্যাব নিয়ে থাকিস। আমি আসছি।
প্রধান শিক্ষক: তুমি কথাবার্তা ভন্দ্র ভাবে বলো।
মাজহারুল : আমরা যেভাবে ভন্দ্রতা জনগণকে দেখায় , তত ভন্দ্র কিন্তু আমি না।
প্রধান শিক্ষক: তুমি আমার ছাত্র ছিলে, এভাবে বলছো কেন।
মাজহারুল : অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলে, এই শহরে এমন কোন অফিসার নেই। আমাকে দেখে নাবিল সাহেবের প্রতিনিধি মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ার এগিয়ে দেয়। আর তোর কত বড় সাহস! তুই নাবিল আহমেদের ডিও লেটার উপর এখনো কমিটি আবেদনের দরখাস্ত দিস নে। তোর যে আব্বাগুলো আসে, তাদের বলবি। মাজহারুল এই এই হুমকি দিয়েছে। তাদের আমারে কিছু করে নিতে বলিস।
প্রধান শিক্ষক: কাউকে বলা লাগবে না। আমি সুস্থ হয়ে নেই। তার পরে দেখবানে।
মাজহারুল : তা তোর সুস্থ হওয়া লাগবে না। তুই কিভাবে যশোরে থাকিস আমি দেখবানে। তুই যদি যশোরে থাকতে পারিস। আমি আর যশোরে রাজনীতি করবো না। তোর চাকুরি থাকে কিনা দেকিস। তোরে এতোদিন কিছু বলেনি। এতোদিন ভদ্রতা দেখাইছি। তুই আমার স্যার তাই। এখনো অভদ্রতার কিছু দেখিস নে তুই। (অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে) তুই জামায়াত করে এখনো এই জায়গায় আছিস তোর কপাল ভালো বলে ফোন কেটে দেন এই যুবলীগনেতা।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ৬ মিনিট ৮ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিওটা তার বলে নিশ্চিত করেছেন অভিযুক্ত সদর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাজহারুল ইসলাম মাজহার। তবে ভাইরাল হওয়া অডিওটাতে তার কথোপকথনে কিছু কথা এডিট করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, স্থানীয় সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ এডহক কমিটির সভাপতি হিসাবে মনিরুজ্জামানকে নিযুক্ত করতে ডিওলেটার দেন। তার পরেও তিনি বিভিন্ন খামখেয়ালি মতো করে কমিটির আবেদন করছে না। আমি স্থানীয় এমপির এই ইছালি ইউনিয়নে প্রতিনিধিত্ব করি। বারবার প্রধান শিক্ষকের কাছে গেলে তিনি মামলার অজুহাত দিয়ে কমিটির আবেদন করছেন না। তাই উত্তেজিত হয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বেশকম কিছু কথা বলেছি। স্যাররে যা কিছু বলেছি সব রাগের মাথায় বলেছি। তবে ভাইরাল হওয়া অডিওটিতে কিছু এডিট করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এই বিষয়ে ভুক্তভোগীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে মুঠোফোনে হুমকির কথোপকথনের অডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর থেকে প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীর পরিবার। নাম না প্রকাশে তার এক স্বজন জানিয়েছেন, মাজহারুল ইসলাম ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও স্থানীয় সংসদ এবং উপজেলা পরিষদের অনুসারী হওয়ায় প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলামের পরিবারের সকল সদস্যরা বর্তমানে আতংকে ও জানমালের নিরাপত্তায় রয়েছেন। দ্রæত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন বলে জানিয়েছেন তারা।