যশোরে বিএডিসি’র বীজে শতাধিক কৃষকের সর্বনাশ
প্রতিবেদক :
যশোর সদর উপজেলায় দেয়াড়া ইউনিয়নে বিএডিসি’র বোরো ধানের বীজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শতশত কৃষক। কৃষকদের অভিযোগ, বিএডিসির সরবরাহ করা ব্রি ধান-৬৩ ধানের বীজে ধানগাছ হয়েছে একাধিক জাতের। বিভিন্ন ধানের মিশ্রণ থাকায় কোনটায় শীষে ধান ধরেছে, আবার কোনটায় এখনো ধানই আসেনি। একই জমিতে ফসলের এমন তারতম্য থাকায় কৃষকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাতে চাষাবাদের খরচ ও ফসল উৎপাদনের ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে এক জাতের বীজে একাধিক জাত তৈরির কারণ উদ্ঘাটন ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপ‚রণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে বিএডিসি’র ডিলারের দাবি, বীজে কোন ভেজাল নেই। কৃষকদের জমির উর্বরতা না থাকায় এমনটি হয়েছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের দত্তপাড়া বাজারে বিএডিসি’র ধানের বীজ বিক্রি করেন কে কে সীডস্ এন্ড এগ্রো ইনপুটস্ লিমিটিডের স্বত্বাধিকারী কৃষিবিদ কল্লোল কুমার ঘোষ। চলতি মৌসুমে এই ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক কৃষক এই ডিলারের কাছ থেকে ব্রি ধান-৬৩ জাতের বোরো ধানের বীজ কিনে চাষাবাদ শুরু করেন।
কৃষকেরা সঠিক মাত্রায় খেতে সেচ, সার দেন। অন্য সবার মতো তাদের খেতও দেখতে সুন্দর হয়। কিন্তু ধানগাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেতের ফসলে তারতম্য দেখা দেয়। খেতের কিছু অংশে যখন ধানের থোড় আসছে। অন্য অংশে আসছে না। আবার কোন জমিতে ধানের থোড় শীষ পরিপুক্ত হয়ে গেছে; অন্য পাশে এখনো থোড়’ই বের হয়নি। জমির ফসলের এ রকম তারতম্য দেখে তারা ফলন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। প্রতিবিঘায় ধান চাষে তাদের ১৩-১৫ হাজার খরচ হয়েছে। এসব জমিতে স্বাভাবিক ধান হলে বিঘায় ২২-২৫ মন ধান উৎপাদন হয়। এখন জমির ফসলের এ রকম তারতম্যের কারণে এই সব জমিতে বিঘায় ১০ থেকে ১৫ মণ ধান উৎপাদন হবে। যাতে এসব কৃষকদের বিঘা প্রতি ১২-১৫ হাজার টাকা ক্ষতি হবে বলে জানান তারা। শেষ সময়ে এসে খেতের ফসলের এ অবস্থায় সবাই ভেঙে পড়েছেন। ফসল ঘরে তুলতে না পারলে সার-সেচের ঋণ পরিশোধ করবেন কীভাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা।
দেয়াড়া ইউনিয়নে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মঠবাড়ী গ্রামের কৃষকেরা। এই গ্রামের হয়রত আলী নামে বয়োজৈষ্ঠ কৃষক জানান, ফলন বেশি হওয়ার আশায় মাঠের পর মাঠ ব্রি ধান-৬৩ চাষ করেছি আমরা। অথচ জমিতে ভেজাল ধানের গাছ লক্ষ করা যাচ্ছে। এতো দিন কিছু বুঝা যায়নি। সেই ধানের থোড় বের হয়েছে, তখনি বুঝতে পেরেছি। দত্তপাড়া বাজারের ডিলার কল্লোল কুমার ঘোষ আমাদের সাথে প্রতারিত করেছে। এখন আমাদের পথা বসা ছাড়া কিছু করার নেই। এই গ্রামের সুলাইমান হোসেন নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেন, অনেক কৃষক তো এই ব্রি ধান ৬৩ জাতের পাশাপাশি অন্য জাতের ধান চাষ করেছে। ফলে তারা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আমার তো ৬ বিঘায় এই ভেজাল ব্রি-ধান ৬৩ জাতের ধান চাষ করেছি। ফলে সব জমিতেই ভেজাল ধানের শীষ বের হচ্ছে। ফলে এই ৬ বিঘায় আমার ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়ে গেলে। সেচ-সারের দাম পরিশোধের সাথে এখন আমি সারা বছরের খাওয়ার ধানও রাখা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছি। লুৎফর রহমান নামে এক কৃষক জানান, কৃষিবিদ কৃষিবিদ কল্লোল কুমার ঘোষের পরামর্শে তার ডিলার থেকে ৪ বিঘা ধান লাগিয়েছি। এখন সব ধানেই ভেজাল। এই ভেজাল ধান বিক্রি করতে পারবো না। এতো টাকা খরচ করে রোদে পুড়ে এই ধান চাষ করে শেষ সময়ে খেতের ফসলের এ অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছি। ইউনুচ আলী নামে আরেক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেন, ২২শ’ টাকা দিয়ে দুই বস্তা ব্রি ধান ৬৩ জাতের ধানের বীজ কিনেছিলাম। এখন জমিতে সেই ধানের চারা লাগিয়ে দেখছি জমিতে ব্রি-ধান ৬৩ জাত ছাড়াও ব্রি ধান ২৮, মিনিকেট, ব্রি ধান ৫৬ জাত ধানের শীষ বের হচ্ছে। আবার খেতের কোনো অংশে ধান বেরই হয়নি। এই গ্রামের প্রায় ৮০ জন কৃষক ৫০ একক জমিতে তাদের এই সমস্যা। বিএডিসি’র বীজ নিয়েও আমাদের এভাবে ঠকতে হচ্ছে। যারা ভেজাল বীজ দিয়ে কৃষকদের সর্বনাশ করলো আর এই ক্ষতির তালিকা করে ক্ষতিপ‚রণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে কৃষকরা। এই বিষয়ে বীজ বিক্রিতা কে কে সীডস্ এন্ড এগ্রো ইনপুটস্ লিমিটিডের স্বত্বাধিকারী কৃষিবিদ কল্লোল কুমার ঘোষের দাবি, আমি বাড়িতে বীজ তৈরি করি না। আমি বিএডিসির ডিলার নিরাঞ্জন ট্রেডার্সের কাছ থেকে বীজ কিনেই কৃষকদের মাঝে বিক্রি করেছি। যদি বীজে ভেজাল থাকে তা হলে বিএডিসির ডিলার বা বিএডিনির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। তবে বিএডিসির ডিলার নিরাঞ্জন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নিরাঞ্জন ব্রি ধান ৬৩ জাতের বীজ ভেজাল না দাবি করে তিনি বলেন, ঐ ইউনিয়নে যেসকল কৃষকরা ব্রি ধান ৬৩ আবাদ করেছে; সেই সকল চাষীদের জমি পরিদর্শন ও তাদের সাথে কথা বলেছি। বীজের সমস্যা না, মূল ঘটনা হলো জমির উর্বরতা। যেখানে ভালো উর্বরতা রয়েছে; সেখানে দ্রæত ধানের শীষ বের হয়েছে। আর যেখানে উর্বরতা নেই; সেখানে এখনো ধানের শীষ বের হয়নি। এই বিষয়ে যশোর বিএডিসি’র উপ পরিচালক খোরশেদ আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজী হয়নি। এই বিষয়ে যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক দীপঙ্কর দাস বলেন, এতে ফলন খুব একটা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কী কারণে এমনটা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখবেন বলে জানান তিনি।