Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ গুরুসদয় দত্ত

0

বাবলু ভট্টাচার্য :

“চল কোদাল চালাই/ হবে শরীর ঝালাই
খাব ক্ষীর আর মালাই/ চল কোদাল চালাই”

ছোটবেলায় স্কুলে আমরা অনেকেই এই ব্রতচারী ছড়া বা গানটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ব্রতচারীর স্রষ্টা হলেন গুরুসদয় দত্ত। জ্ঞান শ্রম সত্য ঐক্য আনন্দ এই পঞ্চব্রতকে জীবনের মূলচাবিকাঠি মনে করে প্রকৃত মানুষ গড়ার যে প্রচেষ্টা নেন তাই হল ব্রতচারী আন্দোলন। এ ছাড়াও বাঙালির লোক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং লোকনৃত্যগীতের চর্চার জন্য ব্রতচারী আন্দোলন শুরু করেছিলেন গুরুসদয়।

‘ব্রত’ শব্দের অর্থ তপস্যা ও সংযমের সংকল্প। বিশেষ ব্রত নিয়ে যারা চলে, তারাই ব্রতচারী। ব্রতচারীকে প্রথমেই পাঁচটি ব্রতে আস্থা আনতে হয়। জ্ঞান, শ্রম, সত্য, ঐক্য আর আনন্দ হচ্ছে এই পঞ্চব্রত। জীবনের পথে জ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা ও কায়িক শ্রমের প্রয়োজন উপলব্ধি করেছেন গুরুসদয়।

সত্যনিষ্ঠা সমাজ-জাতি-দেশ এবং সর্বমানবের কল্যাণের সহায়ক। ‘ঐক্য’ প্রসঙ্গে প্রচলিত বচনই রয়েছে ‘একতাই বল’, বলা আছে ‘দশে মিলি করি কাজ/হারি জিতি নাহি লাজ’। শেষ ব্রত ‘আনন্দ’ কঠিন সাধনাকে সহজ করে। একালে এসব খুব ফাঁকা-কথা মনে হতে পারে। কেননা মূল্যবোধ বিপর্যস্ত হয়ে সমাজের মানুষ আজ বিপথগামী। কিন্তু দেশ-কাল-সমাজের স্বস্থ হবার উপায় ব্রতচারী চর্চা।

সমাজ সেবাব্রতী গুরুসদয় দত্ত প্রণীত বিধিমালা ব্রতচারীকে দেশপ্রেম, ঐতিহ্যপ্রীতি, শিষ্টাচার ও সামাজিক আচরণ, যেমন বাকসংযম, স্বরসংযম, ভাষাব্যবহারের আদর্শ শিক্ষা দেয়। ব্রতচারীর জন্যে আরও আছে-রাগ-ভয়-ঈর্ষা-লজ্জা- ঘৃণা বর্জনের নির্দেশ। পরস্পর দেখা হলে হাত তুলে ‘জয় সোনার বাঙলা’ (জসোবা) সম্ভাষণ আজও আমাদের সবাইকে বাঙালিত্বে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাকে সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী করবার আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত করে আজও।

গুরুসদয় দত্ত বালক বয়স থেকেই ছিলেন দুরন্ত, নির্ভীক, আর একই সঙ্গে হৃদয়বান। বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর বালকই ছিল তাঁর খেলার সাথী। সংস্কারের বেড়াজালে বদ্ধ সে-কালের সমাজে এ আচরণ গ্রহণীয় ছিল না। বড় হয়েও কি-নমঃশূদ্র, কি-মুসলমান সকলের প্রতি তাঁর সৌহার্দ্য অবিচল ছিল।

অল্প বয়সে কুস্তি, হা-ডুডু, গাছে-চড়া, সাঁতার-কাটায় সকলেই ছিল তাঁর সহচর। জেলেদের জীবনে তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। একা একা বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটে বেড়াতে ভালোবাসতেন তিনি। এই দুর্দান্ত বালক কালে কালে চমত্‍কার সুগঠিত দেহের অধিকারী হন। এই হচ্ছেন গুরুসদয় দত্ত।

খেলাধূলা আর মাঠেঘাটে দাপিয়ে বেড়ানোর ঝোঁকে ঘটে গেল এক বিপত্তি। পঞ্চম শ্রেণীর অঙ্ক পরীক্ষায় পেলেন শূন্য। একই ক্লাসে থেকে যাবার অপমান সহ্য করা কঠিন। বুনো ঘোড়া বশ করবার জেদ নিয়ে গণিতবিদ্যাকে এমনই কবজা করলেন যে, শুরু হল অঙ্কে প্রথম হবার পালা। জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার এই শিক্ষা পাবার ফলে, আর হোঁচট খেতে হয়নি।

মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার বাধা রইল না আর। ছোট থেকেই ছিলেন অসম্ভব জেদী। যা ভাবতেন সেটাই করে ছাড়তেন। তবে বাধা এল অন্যভাবে। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার আগেই একসঙ্গে বাবা-মা দুজনকেই হারালেন। সাময়িক ভেঙে পড়লেন কিন্ত ঘুরে দাঁড়ালেন। দ্বিতীয় হলেন এন্ট্রান্স পরীক্ষায়। অনাথ কিশোরের এই সাফল্যে উদ্বেল হয়ে উঠল সিলেটবাসি। বাকিটা ইতিহাস।

ঐতিহ্য খুঁড়ে গুরুসদয় দত্ত দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙালি বাস্তবিক পক্ষে বীরের জাতি। বীরভূমের গ্রাম থেকে প্রাচীন বাঙালি যোদ্ধাদের রায়বেঁশে নাচ তুলে এনে ব্রতচারীদের শিখিয়েছিলেন তিনি। সেকালে যুদ্ধজয়ের পরে বীরত্বব্যঞ্জক এই আনন্দনৃত্যের ভিতরে আছে বাঙালির শৌর্যের সংবাদ।

সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ঐক্য আর সম্প্রীতিচর্চার আহ্বানও রয়েছে ব্রতচারী গানে:
‘রাম রহিমের বিবাদ রচে রহিসনে অজ্ঞান-
যেই ভগবান সেই যে খোদা
নাই রে ব্যবধান-‘

গুরুসদয় দত্ত ১৮৮২ সালের আজকের দিনে (১০মে ) সিলেট জেলার বীরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.