Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণ : সাহানা দেবী 

0

বাবলু ভট্টাচার্য : 
বাবা প্যারিমোহন গুপ্ত ছিলেন নামজাদা চিকিৎসক। ডিস্ট্রিক্ট সিভিল সার্জেন। পিতামহ জমিদার কালীনারায়ণ ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। জ্যাঠামশাই কে জি গুপ্ত দুঁদে আইসিএস। বড়মামা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। মাসি অমলা দাশ এইচএমভি-র প্রথম মহিলা সঙ্গীতশিল্পী। পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদ সেন। পিসতুতো ভগ্নীপতি সুকুমার রায়। যার পরিবারের গণ্ডিতে এমন নক্ষত্রসারি তিনি সাহানা দেবী।

জীবনপথে প্রধানত যে তিন জনের প্রভাব সাহানাকে নানা ভাবে এগিয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন ওঠা-পড়ায় তাঁকে প্রয়োজনীয় সহায়তা জুগিয়েছে, তাঁদের প্রথম জন অবশ্যই তাঁর ‘মামাবাবু’ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তার পরে রবীন্দ্রনাথ এবং সর্বশেষ শ্রী অরবিন্দ।

৯৩ বছরের জীবনে সিংহভাগ তাঁর কেটেছে পণ্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমে। বাষট্টি বছর ধরে সেটিই ছিল তাঁর ঠিকানা। ১৯৯০ সালে সেখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়।

চিত্তরঞ্জনের কাছে বরাবর স্নেহ ও প্রশ্রয় পেয়েছেন সাহানা। ছোটবেলাতেই তাঁর বাবা মারা যান। সন্তানদের নিয়ে মা চলে আসেন দক্ষিণ কলকাতায় বাপের বাড়ি।

মামাবাড়ির আবহাওয়ায় বড় হয়ে ওঠা সাহানার জীবনবোধ, আদর্শ সব কিছুতেই তাই মাতৃকুলের, বিশেষ করে মামা চিত্তরঞ্জনের প্রভাব ছিল খুব বেশি। স্বাজাত্যবোধ, উদার মানসিকতা, দানশীলতা ইত্যাদি সেখান থেকেই শেখা। মামিমা বাসন্তী দেবীর কাছেও একই রকম ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি।

চিত্তরঞ্জনের লেখা ‘কেন ডাকো অমন করে, ওগো আমার প্রাণের হরি’ গানটিতে সুর দিয়ে গেয়ে শুনিয়ে তাঁর কাছে পছন্দসই হিরের দুল এবং কণ্ঠহার পুরস্কার পেয়েছিলেন তরুণী সাহানা।

খুব অল্প বয়স থেকেই গান করতেন তিনি। সাত-আট বছরের মেয়ে রেকর্ড থেকে লালচাঁদ বড়ালের গান তুলে ওই রকম গায়কি অনুকরণ করে শোনাতেন। সাহানার বয়স যখন আরও কম, তখন থেকেই শুনে শুনে গান কণ্ঠে তুলে নেওয়ার প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর মাসিমা, বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী অমলা দাশ এক বার সাহানার অন্য দিদিদের একটি টপ্পা শেখাচ্ছিলেন। আড়াল থেকে সেই গান শুনে দিদিদের আগেই মাসিমাকে সেই গান শুনিয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন তিনি।

সাহানা দেবীর প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষার গুরু বিষ্ণুপুর ঘরানার পণ্ডিত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।

প্রথাগত অর্থে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক তিনি ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান ‘নিজের মতো করে’ গাইবার স্বাধীনতা যে দু’-এক জনকে দিয়েছিলেন, সাহানা তাঁদের অন্যতম। ‘নৃত্যের তালে তালে’ গানটিতে চারটি স্তবক ভিন্ন ভিন্ন তালে বাঁধার ভাবনা সাহানার। কবি তা গ্রহণ করেছিলেন। তাই সাহানাকে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, তাঁর কণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীতে যতটা স্রষ্টা আছেন, ততটাই আছেন এই গায়িকা।

সাহানাকে গান শেখানোর জন্য সুরেন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন তিনি বছর বারোর কিশোরী। গান গাইতে এতই ভালোবাসতেন সাহানা যে, একবার গান গাওয়া আরম্ভ করলে একটানা একশো-দেড়শো গান গেয়ে যেতেন। এমনও হয়েছে, অনেক বার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-কন্যা মীরাদেবীর ঘরে বসে সারা রাত গান গেয়েছেন। চোখের সামনে ভোর হয়ে গিয়েছে।

অনর্গল গান শোনানোর এমন তৃপ্তি তিনি পেয়েছেন অতুলপ্রসাদ সেনের সান্নিধ্যেও। পিসতুতো দাদা অতুলপ্রসাদকে তাঁরা ডাকতেন ‘ভাইদা’ বলে।

সাহানা দেবী নিজে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়ে তিনি যে গভীর তৃপ্তি পেতেন, তা আর কোথাও পাননি। কবির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের রসায়নটাও ছিল বড় গভীর। স্নেহ, প্রীতি, অধিকারবোধ সবকিছুর এক অদ্ভুত মিশেল ছড়িয়ে রয়েছে তাঁদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরতে পরতে।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাহানার প্রথম দেখা মামা চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে। তিনি তখন নিতান্ত বালিকা। কেমন ছিল সেই দর্শনের অভিজ্ঞতা? সাহানা লিখেছেন, ‘‘কি সুন্দর চেহারা, কোথায় যেন  যিশুখৃস্টের আদল আসে- গৌরবর্ণ, লম্বা, দোহারা, চোখ নাক মুখ সব যেন দেখবার মতো। দেখলে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।’’

১৯১৬ সালে চিকিৎসক বিজয় বসুর সঙ্গে বিয়ে হয় সাহানার। বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনেক টালমাটাল সময়ের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে তাঁকে। সেই সময়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর পরম নির্ভরতার আশ্রয়।

১৯২৬ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন সাহানা দেবী। শান্তিনিকেতনে থাকতে চেয়ে চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথকে। ব্যবস্থা হয়ে যায়। সাহানা বলেছেন, ‘‘তাঁর মধুর সুকোমল স্পর্শ তখন আমাকে নবজীবন দান করেছিল।’’

সাহানা দেবীর অসুস্থতা ক্রমশ টিবি রোগের আকার নেয়। তখনও, ১৯২৭ সালের গোড়ার দিকে, মাস তিনেক তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। পরে সেখান থেকেই নৈনিতালের কাছে এক স্যানেটোরিয়মে চলে যান। শুরু হয় একাকি জীবনের আর এক অধ্যায়।

অধ্যায় এই কারণে যে, জীবনের এই পর্বেই তিনি আধ্যাত্মিকতায় অনুরক্ত হন। এর পরে কলকাতায় তিনি খুবই কম এসেছেন। শান্তিনিকেতনেও নয়। বরং উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় একা একা ঘুরে অবশেষে ১৯২৮ সালের নভেম্বরে পৌঁছান পন্ডিচেরীতে, শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে। সেখানে শ্রী অরবিন্দের দর্শন ও আশীর্বাদ পান। মাদারের স্নেহ পান। আশ্রমের সেলাই বিভাগে কাজের দায়িত্বও দেওয়া হয় তাঁকে। সেই থেকে আমৃত্যু আর অন্য কোথাও ফিরে যাননি।

দীর্ঘ জীবনপথে এমন বহু বিচিত্র এবং বহুমূল্য অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারি এই অভিজাত রমণী বাঙালির স্মৃতিতে আজ হয়তো অনেকটাই ধূসর। কিন্তু গত শতাব্দির প্রায় সবটা জুড়ে এমন এক বর্ণময় প্রতিভা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে যে ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, তা ভোলার নয়।

সাহানা দেবীর কণ্ঠের গান, বিশেষত রবীন্দ্রসঙ্গীত, স্মৃতির সম্পদ হয়ে রয়ে যাবে চিরকাল।

সাহানা দেবী (ঝুনু) ১৮৯৭ সালের আজকের দিনে (১৭ মে) বাংলাদেশের ফরিদপুরের জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.