Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণ: ইয়ান ফ্লেমিং

0

বাবলু ভট্টাচার্য :
পায়ে গুলি লেগে কাতরাচ্ছে লোকটি। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলেন, “হু আর ইউ?” উত্তর এলো, “দ্য নেইম ইজ বন্ড, জেমস বন্ড।” আড়াল থেকে সামনে এসে দাঁড়ালেন কালো বুট আর কালো স্যুট পরা আকর্ষণীয়, তীক্ষ্ণ পুরুষালি চেহারার এক ব্যক্তি, হাতে মারণাস্ত্র। হ্যাঁ, এই একইসাথে আবেদনময়ী আর অতি চালাক, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূৎ এই মানুষটিই জেমস বন্ড। কোড নাম্বার ০০৭।

জেমস বন্ডের নামের সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ধারালো বুদ্ধির ঘোরপ্যাঁচওয়ালা সব কাহিনি। নাম চরিত্রের মনোমুগ্ধকর পৌরুষ আর প্রত্যেক কাহিনিতে তার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া হৃদয় হরণকারী সব রমনী, এই দিয়ে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যে আর সিনেমাশিল্পে অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান দখল করে আছে জেমস বন্ড। আর সেই সূত্রে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়ে আছেন জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং।

ইয়ান ফ্লেমিং-এর মা ইভলিন রোজ ও বাবা ভ্যালেন্টাইন ফ্লেমিং। বাবা ছিলেন পার্লামেন্টের সদস্য; তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন এবং ১৯১৭ সালের ২০ মে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে জার্মান শেলের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন।

১৯১৪ সালে ইয়ান ডর্সেটের ডার্নফোর্ড স্কুলে ভর্তি হন। স্বাদহীন খাবার, শারীরিক পরিশ্রম আর অন্য ছেলেদের হাতে উত্যক্ত হওয়া- সব মিলিয়ে এখানে তার দিনগুলো ভালো কাটেনি। প্রাতিষ্ঠানিক রেজাল্ট বরাবর খারাপ হতে থাকে। যদিও অ্যাথলেটিক্সে তিনি বেশ পারদর্শিতা দেখান।

শেষমেষ তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবস্থা দেখে পরিবারের দুর্নামের ভয়ে তার মা তাকে অস্ট্রিয়ার কিযবেলের টেনেরফ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন। টেনেরফ ছিল ধনীর বিগড়ে যাওয়া দুলালদের জন্যে বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা চালাতেন সাবেক ব্রিটিশ গোয়েন্দা ইরনান ফোর্বস ডেনিস এবং তার সাহিত্যিক স্ত্রী ফিলিস বটম।

একইসাথে গোয়েন্দাবৃত্তি এবং সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক এদের দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে ইয়ানের ভেতরে আসে। ফ্লেমিং এর বড়ভাই পিটার ছিলেন একজন অভিযাত্রিক এবং ভ্রমণ কাহিনি লেখক। তার প্রভাবে ইয়ানও প্রথমদিকে ভ্রমণ বিষয়ক একটি নন-ফিকশন বই ‘থ্রিলিং সিটিস’ লিখে ফেলেন। পরবর্তীকালে ইয়ান ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ ও ইউনিভার্সিটি অব জেনেভাতে পড়াশোনা করেন।

১৯৩৯ সালের মে মাসে ব্রিটিশ নৌ-ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল জন গডফ্রে ইয়ানকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। তার কোডনেম হয় ‘17F’। ব্রিটিশ অ্যাডমিরালটির ৩৯ নম্বর কক্ষটি ছিল তার কার্যক্ষেত্র। বলা হয়, এই গডফ্রের আদলেই ইয়ান জেমস বন্ডের ‘M’ চরিত্রটির চিত্রায়ন করেন। ইয়ান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নেন। তার এই রোমাঞ্চক জীবনের অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতাই তার লেখায় প্রভাব রেখেছে। সুতরাং বলা যায়- তিনিই নেপথ্যের আসল জেমস বন্ড।

ব্যক্তি ইয়ানেরও এক প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়ে গেছে তার সৃষ্টি বন্ডের মধ্যে। তার তুখোড় ধুমপানের অভ্যেস ছিল। দিনে প্রায় ৮০টির বেশি সিগারেট খেতেন তিনি। এছাড়া ছিল অতিরিক্ত মদ্যপানের বদভ্যাস। ডাক্তার তাকে জিন খাওয়া ছাড়তে বললে তিনি নির্লিপ্তভাবে বারবনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মদ নিয়ে বিলাসিতা জেমস বন্ডের মধ্যেও দেখা যায়। লেবু মিশিয়ে মার্টিনি আর ভদকার ককটেল, ‘শেকেন, নট স্টার্ড’, এই ছিল জেমসের পছন্দ।

১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় বন্ড সিরিজের এই প্রথম বইটি। প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলে দেয় এই উপন্যাস। ক্রমে সব মিলিয়ে বন্ড সিরিজে ১১টি উপন্যাস ও ২টি ছোটগল্প লেখেন ইয়ান ফ্লেমিং।

বিশ্বজুড়ে একশ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে বন্ডের এই উপন্যাস সিরিজ। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ফিকশনগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জেমস বন্ড। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইমস’ ১৯৪৫ সাল থেকে নিয়ে ৫০ জন সেরা ব্রিটিশ লেখকের তালিকায় ১৪তম স্থানে রেখেছে ইয়ান ফ্লেমিংকে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিও ছিলেন ইয়ানের ভক্তদের তালিকায়।

’৬০ এর দশক থেকে শুরু হয় জেমস বন্ডের চলচ্চিত্রায়ণ। সব মিলিয়ে ২২টি সিনেমায় ৬ জন অভিনেতা জেমস বন্ড হয়েছেন এ পর্যন্ত। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্ড বলা হয় পিয়ার্স ব্রসনানকে।

১৯৫৩ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’ সিনেমায় রূপান্তরিত হয় ২০০৬ সালে। এতে বন্ডের ভূমিকায় ছিলেন ড্যানিয়েল ক্রেইগ। জেমস বন্ডের লুক বা চেহারার ধারণাটি ইয়ান গ্রহণ করেন মার্কিন গায়ক হাওয়ার্ড কারমাইকেলের চেহারা থেকে। আর এই কিংবদন্তী নাম ‘জেমস বন্ড’ ইয়ান নেন তার ছোটবেলায় পড়া ‘বার্ডজ অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ বইয়ের লেখকের নাম থেকে।

অতিরিক্ত ধুমপান ও মদ্যপানের কারণে ১৯৬১ সালে ইয়ান ফ্লেমিং একবার হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। তবে সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। ১৯৬৪ সালের ১১ আগস্ট ক্যান্টারবারিতে তিনি পুণরায় হার্ট অ্যাটাক করেন এবং ১২ আগস্ট ৫৬ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।

তার মৃত্যুর পরে বন্ড সিরিজের দুটো ছোটগল্প ‘দ্য ম্যান উইদ দ্য গোল্ডেন গান’ এবং ‘অক্টোপুসি অ্যান্ড দ্য লিভিং ডেলাইটস’ প্রকাশিত হয়।

ইয়ান ল্যাঙ্কাস্টার ফ্লেমিং ১৯০৮ সালের আজকের দিনে (২৮ মে) লন্ডনের মেফেয়ারের ২৭ নং গ্রীন স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.