Take a fresh look at your lifestyle.

পানিতে ডুবে সন্তান হারানো তিন পরিবারে কান্না থামছে না

0

প্রতিবেদক :
যশোরের বাঘারপাড়া চাড়াভিটা পাওয়ার হাউজের বামদিকে চলে গেছে পিচঢালা এক সড়ক। সড়কটিতে মিনিট পাঁচেক এগিয়ে গেলে ডানপাশে দেখা মিলবে বিশাল দুটি পুকুর। পুকুরের মাঝবরাবর সরু পথ দিয়ে এগিয়ে গেলেই বাগানের মধ্যে সুমাইয়ার টিনের ছাউনির চৌচালা ঘর। পুরো নাম সুমাইয়া আক্তার শান্তা (৯)। সোমবার দুপুরে স্কুল ছুটি শেষে বাড়িতে এসে স্কুল ড্রেস খুলে প্রতিবেশী খেলার সাথীদের সাথে পুকুরে যায় গোসল করতে। গোসল করার একপর্যায়ে সুমাইয়া ও তার দুই প্রতিবেশি খেলার সাথী তমা ও হোসাইনকে সঙ্গে নিয়ে ডুবে মারা যায় সুমাইয়াও।

মঙ্গলবার (৩১ মে) দুপুরে সুমাইয়ার বাড়ির কাছে যেতেই শোনা গেল তার মা গুনজার বেগমের আহাজারি, ‘আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম রে আল্লাহ, তুমি আমার সাথে কি কাজটাই না করলা। তোরা আমার বুকের ধনরে এনে দে’। যশোরের বাঘারপাড়ার বাসুয়াড়ি ইউনিয়নের পূর্ব শ্রীরামপুর এলাকায় পুকুরে গোসল করতে নেমে পানিতে ডুবে একসাথে তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ডুবে যাওয়া তিন শিশু হলো ঐ এলাকার পূর্ব শ্রীরামপুর গ্রামের কামরুল ইসলামের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার শান্তা (৯), একই গ্রামের হারুন মোল্লার মেয়ে তমা খাতুন (৮) ও আবু সাঈদ মোল্লার ছেলে হুসাইন (৬)। এরমধ্যে সুমাইয়া ও তমা দক্ষিণ শ্রীরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ও হুসাইন প্রাক প্রাথমিকে পড়াশোনা করতো। মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটার পর এদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় ঈদগা মাঠে নামাজের জানাযা শেষে তিন শিশুর দাফন সম্পন্ন করে স্বজনরা।

একশ’ গজের মধ্যে তিনটি বাড়িতে ফুলের মতো তিনটি শিশুর জীবনপ্রদীপ হঠাৎ নিভে যাওয়ার নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন শিশুদের পিতা-মাতা। থামছে না স্বজনদের কান্না। শোকে মুহ্যমান-বাকরুদ্ধ এলাকাবাসী।

সুমাইয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সে যে ঘরে থাকত, সেই ঘরের বড় বাক্সের পরে স্কুলব্যাগটি পড়ে রয়েছে। অগোছালো ঘরটি বিভিন্ন জায়গায় সুমাইয়ার স্মৃতি ঝুলছে। দেয়ালে সুমাইয়ার ছবি, আলনাতে ঈদের নতুন জামাসহ আরও কত কি। বারান্দায় সুমাইয়ার মাকে ঘিরে ননদ-প্রতিবেশীদের জটলা। সবাই সুমাইয়ার মা গুনজার বেগমকে ভাত খেতে সাদছে। মেয়েকে ছাড়া কিছুই খাবে না বলে জেদ করেছেন তিনি। এর আগেও বছর দুই আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত ১০ বছর বয়সী ছেলে মিঠুনকে হারিয়েছেন তিনি। তাই সংসারে একমাত্র সন্তান মেয়ে সুমাইয়াকে আকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্নে সেই ছেলে হারানোর দুঃস্মৃতি ভুলেছিলেন। কিন্তু এবার একমাত্র বুকের ধন হারিয়ে তিনি নির্বাক হয়ে গেছেন। বারবার সৃষ্টিকর্তাকে প্রশ্ন ছুড়ছেন তিনি। আর বলছেন ’আল্লাহ তুমার কাছে এত কি পাপ করেছি; তুমি এমন শাস্তি দিচ্ছাও কেন’ তুমি আমার মেয়েকে না নিয়ে আমাকে নিতে পারতে। আমি এখন কারে নিয়ে বাঁচবো। পাশেই সুমাইয়ার খালা জুলি বেগম বলেন, একমাত্র সন্তানরে হারিয়ে সুমাইয়ার মা-বাবা এখন বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। গতকাল থেকেই দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে রয়েছেন।

পানিতে ডুবে সন্তান হারানো পরিবারে স্বজনদের কান্না থামছেই না, ছবি : কপোতাক্ষ

দু’বাড়ি যেতেই হুসাইনের বাড়ি। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ির পিছনে বাগানে বিছানা পেতে হুসাইনের মা জহুরা বেগম আর বাবা আবু সাঈদ মোল্লা গুমমে গুমরে কাঁদছে। পাশেই হুসাইনের ফুফু আর কয়েকজন প্রতিবেশীদের তাদের সান্তনা দিতে দেখা যায়। তার একটি বাড়ি পরেই তমাদের বাড়ি। বাড়িতে বারান্দায় কাঁদছে তমার মা পুতুল বেগম। তিনিও গুমরে গুমরে কান্নাস্বরে বলতে থাকেন স্কুল থেকে ফিরেই তমা ড্রেস পরিবর্তন করে টিভি দেখছিল। কিছু সময় পরে টিভি বন্ধ করে খেলতে যায়। পরে স্থানীয়দের মাধ্যমে শুনতে পায় তার মেয়ে মারা গেছে। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এখন আমার কোনো সন্তান নেই। কাকে নিয়ে আমি বাঁচব এই বলেই পাশে থাকা এক নারীকে জড়িয়ে ধরে হাও মাও করে কাঁদতে লাগলেন।

পানিতে ডুবে সন্তান হারানো পরিবারে স্বজনদের কান্না থামছেই না, ছবি : কপোতাক্ষ

স্থানীয় বয়োজৈষ্ঠ নুরুল হক জানান, আমার বয়সে একপাড়ায় একসাথে তিনজন মারা যেতে দেখিনি। এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পর থেকে আশেপাশের দুই-তিন ইউনিয়নের লোকজন দুইদিন ধরে ডুবে যাওয়া শিশুদের বাড়িতে আসছেন। সন্তানদের হারিয়ে তিন পরিবারই পাগল প্রায়। ডুবে যাওয়া তিন শিশুর মধ্যে দুই জনের বাবা-মা একেবারেই সন্তানহারা হয়েছে।

স্থানীয় বাসুয়াড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান সরদার বলেন, তিন শিশুর মৃত্যুতে আমরা খুবই শোকাহত। শিশুদের বাড়িতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা এসেছেন। আমরা তিন পরিবারের জন্য কিছু সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.