মুম্বাইয়ে ‘রহস্যজনক মৃত্যুর’ শিকার নাবিক রাশেদের বাড়িতে কবরের নিস্তব্ধতা
উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ, বিচার দাবি
প্রতিবেদক :
মুম্বাইয়ে বাংলাদেশি জাহাজে ‘রহস্যজনক মৃত্যুর’ শিকার নাবিক আবু রাশেদের (২২) মণিরামপুরের মনোহরপুর গ্রামের বাড়িতে এখন কবরের নিরবতা। দশদিন আগে মৃত্যুর শিকার রাশেদের দাফন আজ শনিবার (১১ জুন) সকালে সম্পন্ন হয়েছে। স্বজনদের বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারির মধ্যে দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর এখন বাড়ি কবরের নিস্তব্ধতা। মাঝে মধ্যে আহাজারি আর কান্নার রোল বিদির্ণ করে দিচ্ছে সেই নিস্তব্ধতাকে। আহাজারিতে সন্তানহারা বাবা-মা আঙুল তুলছেন জাহাজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিকে। জাহাজে অমানবিক শারীরিক মানসিক নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে তার; এমনই অভিযোগ স্বজনদের।
আবু রাশেদ যশোরের মণিরামপুর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমারঘাটা গ্রামের আব্দুর সবুর সরদার ও পারুল বেগমের ছেলে। বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমির ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রাশেদ গত মার্চে বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি জাহাজ মনিতে ডেক ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেছিলেন। গত ৩০ মে ভারতের মুম্বাই বন্দরের জলসীমায় নোঙর করা অবস্থায় বাংলাদেশি এমভি জাহান মনিতে অনবোর্ড থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সেখানকার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ মে সকালে তার মৃত্যু হয়। তার স্বজন, সহকর্মী ও পরিবারের অভিযোগ, গত দুই মাস ধরে জাহাজে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় একটি হাসপাতালে রাসেলের মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার (১০ জুন) সন্ধ্যায় তার মরদেহ মুম্বাই থেকে ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। সেখানে লাশ গ্রহণ করে স্বজনেরা বাড়িতে নিয়ে আসেন। শনিবার ভোররাতে রাশেদের কফিনবন্দি মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর পর বাবা মা আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। শনিবার সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় ঈদগাহে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
আবু রাশেদের এভাবে চলে যাওয়া কেউই মেনে নিতে পারছেন না। আর্থিক অনটনের সংসারে একবুক স্বপ্ন নিয়ে জাহাজে চাকরি নেওয়া রাশেদের এমন মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী।
শনিবার সকালে রাশেদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তার বাড়ির উঠানে টাঙানো সামিয়ানা, চেয়ারে উঠান ভর্তি মানুষ। কেউ রাশেদের বাবাকে সান্তনা দিচ্ছেন, কেউ বা কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শেষ হওয়া রাশেদের গর্ভধারিণী মাকে মাথায় তেল-পানি দিচ্ছেন। ছোট ছেলে আদরের ধনের মৃত্যুর খবরে অনেকটা নির্বাক বাবা আব্দুর সবুর সরদার। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন ছামিয়ানার নিচে রাখা ছেলের কফিনের দিকে। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন সবুর সরদার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ও আল্লারে…। আমার আব্বু ভালো মানুষ ছিলো। সবার সাথে ভালো করে কথা কইতো। ওর কোনো কিচুতে লোভ ছিলো না। আমারে ফোন দিয়েই কি খেয়েছো শুনতো। আমার আব্বুরে কি কষ্ট দিয়ে মেরেছে। মুখে সারা শরীরে কোনো দাগ ছিলো না; এখন সারা শরীর মুখে দাগ রয়েছে।’ মাটিতে পা দাপাতে দাপাতে কান্নাজড়িত কন্ঠে আত্মচিৎকার করে বলেন, ‘ও আল্লাহ তুমি আমার আব্বুরে ফিরায়ে দাও; তার বদলে আমারে নিয়ে নাও।’
ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে বিলাপ থামছে না পারুল বেগমের। ১০ দিন কাঁদতে কাঁদতে যেন দুচোখের সব জল শেষ হয়েছে। চাপা স্বরে পারুল বেগম বলেন, ‘মৃত্যুর আগের দিন আমার সাথে কথা হয়েছিল। সে অসুস্থ তার পরেও আমাকে শান্তনা দিতে বলেছে, আমি ভালো আছি। কিন্তু রাশেদের কথার স্বর শুনে আমি বুঝে ফেলেছিলাম ও ভালো নেই। ও আমাগের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতো। বলতো অভাবের সংসার থেকে আমরা বড় হয়েছি। একটা দুইতালা বাড়ির নকশা করেছি। এবার ঈদের পরে বাড়িতে এসে বাড়ি বানাবো। আমরাও তাকে বলেছিলাম, ঈদে বাড়িতে আসলে তোরে বিয়ে দিব। আমাদের স্বপ্ন শেষ; একসাথে ওরও সব স্বপ্ন শেষ! আমার ছেলেরে কিভাবে না নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে ওরা। ও আল্লাহ আমার ছেলেরা যারা এমন কষ্ট করে মেরেছে, তাদেরও পরাণডা একই ভাবে কেড়ে নিও…!’
রাস্তার পাশে বারবার মুর্ছা যেতে যেতে আবু রাশেদের বড়ভাই রাসেল পারভেজ বলেন, মাস খানিক আগে রাশেদ আমারে ফোন দিয়ে বলে, ‘ভাই আমার খুব জ্বর এসেছে। ওরা আমারে চিকিৎসা করাচ্ছে না। অসুস্থতার ছুটি চাইলে তারা বিভিন্ন অ্যান্টবায়েটিক দিয়ে আমারে আরো অসুস্থ করে ফেলছে। তুই দেখ আমারে কোনোভাবে ছুটির ব্যবস্থা করে দিতে পারিস কিনা। একপর্যায়ে রাশেদ ওই এমভি জাহান মনির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ছুটি চাইতে গেলে তারা রাশেদকে বলে ‘তোর লাশ যাবে এই জাহাজ থেকে; তবে তোর কোনো ছুটি হবে না।’
তিনি অভিযোগ করেন, রাশেদ জাহাজের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ছুটি চাইলে তাকে ছুটির বদলে তাকে বেশি বেশি ওভার টাইম করাতো। বিভিন্ন ইনজেকশন দিত। ইনজেকশন দেওয়ার পলে রক্তবমি করতো। দিনদিন রাশেদের শরীর খারাপ হওয়াতে ও বুঝতে পেরেছিল, ও আর বাঁচবে না। তাই গ্রামে আত্মীয় স্বজনের কাছে ফোন করে মাফ চেয়ে নিয়েছে। জাহাজে অনবোর্ড হওয়ার পর থেকে সমুদ্রে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতকালে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করছিলো বলে বিভিন্ন সময়ে ফোনে পরিবারের কাছে অভিযোগ করেছে। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় সঠিক তদন্ত দাবি করছি। তার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি ও উপযুক্ত ক্ষতিপ‚রণ দাবি করেন রাশেদের বড়ভাই রাসেল।
রাশেদের একাডেমির বড়ভাই সাকিব সাংবাদিকদের জানান, ‘আমরা জানতে পেরেছি; অনবোর্ড হওয়ার পর থেকেই আবু রাশেদের ওপর কাজের অনেক প্রেসার দেওয়া হতো। ভোর ৪টা থেকে টানা রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনবরত ডিউটি করতে বাধ্য করা হতো। এর ফলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের দিকে সে জ্বরে আক্রান্ত হয়। জ্বরের জন্য তাকে তিন দিন জাহাজে আইসোলেটেড করা হয়। পরবর্তীতে জ্বর কমলে আবারও প্রতিদিন তাকে ১৬-১৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে বাধ্য করা হয়। গত সপ্তাহে রাশেদ গুরুতর অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে কিছু এন্টিবায়োটিক খেয়ে ডিউটিতে যেতে বাধ্য করা হয়। ‘গত ৩০ মে মুম্বাই বন্দরে জাহাজটি এংকর লোড করার সময় তার মাথা ঘুরে পড়ে যায় এবং তার রক্তবমি শুরু হয়। এসময় তাকে ফ্রেশ ওয়াটারের বোটে করে মুম্বাইয়ের শোরে হসপিটালে আনা হয়। এরপর ৩১ মে সে মৃত্যুবরণ করে।’
নাবিক আবু রাশেদের মরদেহ যশোরের গ্রামে বাড়িতে নিয়ে আসে তার কর্মস্থল চট্টগ্রামের এসআর শিপিং লিমিটেড কোম্পানি।
কোম্পানির নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম টুটুল জানান, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় গত ৩১ মে তাকে মুম্বাইয়ের জে জে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার পর রাশেদের লাশ শুক্রবার বিকালে ঢাকা আন্তজার্তিক বিমানবন্দর থেকে নিয়ে নিজ গ্রামে আনা হয়েছে। পরিবার থেকে কোম্পানির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সবই মিথ্যা। কোম্পানি থেকে রাশেদের পরিবারের সবধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।