বাবলু ভট্টাচার্য :
হাজার রজনীর অধিক সময় মঞ্চে নিজের অভিনয় প্রতিভার মধ্য দিয়ে দর্শকের মনে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার মতো কিছু অনন্য সাধারণ নাট্যজনের হাত ধরেই যাত্রা করেছিল বাংলাদেশের মঞ্চ নাটক। তাকে ছাড়া আমাদের থিয়েটারের ইতিহাস কখনো সম্পূর্ণ হবার নয়। তিনি বাংলা নাট্য মঞ্চের সম্রাজ্ঞী ফেরদৌসী মজুমদার।
তাদের পৈতিক নিবাস নোয়াখালীতে। তার বাবা খান বাহাদুর আব্দুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট। তার ভাইবোন ছিল মোট ১৪ জন যাদের মধ্যে ৮ জন ভাই এবং ৬ জন বোন। তাদের পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল।
নারী শিক্ষা মন্দির স্কুলে শুরু হয় ফেরদৌসী মজুমদারের লেখাপড়া। এই স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ভর্তি হন মুসলিম গার্লস স্কুলে যেখান থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর ইডেন কলেজে ভর্তি হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা এবং আরবি বিভাগ থেকে ডাবল এমএ কোর্স সম্পন্ন করে নয়াদিল্লির নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেলোশিপ লাভ করেন ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি রাজধানীর ‘সান বিমস’ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ফেরদৌসী তার বড়ভাই মুনীর চৌধুরী থেকে একটা নাটকে রোবটের চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব পান। শওকত ওসমানের লেখা এই নাটকের নাম ছিল ‘ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা’। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল তৎকালীন ইকবাল হলে যা এখন জহুরুল হক হল।
বাবা-মা’র অমতে তিনি ১৯৭০ সালের ১৩ জুন রামেন্দু মজুমদারকে বিয়ে করেন। ১৯৭১ সালের শুরুতে তিনি পাকিস্তানের করাচীতে চলে যান একটা অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মে কাজ করতে। পরে ১১ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মে মাসে তার পরিবারের সবাই (মুনীর চৌধুরী) কলকাতা চলে যান।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সংস্কৃতি চর্চার অগ্রগণ্য এ অভিনেত্রী দেখেছেন দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের রূপান্তর। সংস্কৃতির ভাঙা-গড়ার স্বাক্ষীও হয়ে আছেন গুণী এই মানুষটি। নবনাট্য আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার ভূয়সী অংশীদারিত্ব বাঙালি জাতিকে করেছে কৃতার্থ। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারি, নাট্যদল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা। আবদুল্লাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে তিনিও সেই দলে যোগ দেন।
তার অভিনীত টেলিভিশন ও মঞ্চনাটকের মধ্যে ‘বরফ গলা নদী’, ‘খাঁচা’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘অকূল দরিয়া’, ‘চোখের বালি’, ‘সংশপ্তক’, ‘নিভৃত যতনে’, ‘কোকিলারা’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও দুঃসময়’, ‘দুই বোন’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘বারামখানা’ এবং ‘মুক্তধারা’ উল্লেখযোগ্য।
টিভি, মঞ্চ ছাড়াও তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। তার নির্দেশিত মঞ্চনাটকের মধ্যে ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘চিঠি’, ‘তাহারা তখন’, ‘মেহেরজান আরেকবার’ এবং সম্প্রতি রবিঠাকুরের ‘মুকুট’।
১৯৯৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এবং প্যারিসে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সসম্মানে আমন্ত্রিত ফেরদৌসী মজুমদার।
ক্লান্তিহীন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর করণীয় কাজের মধ্যে দিয়ে যেমন অর্জন করলেন একুশে পদক, প্রথম জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট, শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, উইলিয়াম কেরি পদক, ঋষিজ পদক, অন্যদিন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড, মুনীর চৌধুরী সম্মাননা, মেরিল-প্রথম আলো তারকা জরিপ ২০০৬ আজীবন সম্মাননা। তেমনি দেশ ছাড়িয়ে অভিনয় করলেন ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর- একবার এবং বারংবার।
প্রতাপশালী অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রায় তিনশর বেশি নাটকে অভিনয় করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় নাটক ‘সংশপ্তক’র বহুল আলোচিত ‘হুরমতি’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকহৃদয়ে আসন করে নেন।
আবদুল্লাহ আল মামুন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারকে নিয়ে ৮৬ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, যার নাম ‘জীবন ও অভিনয়’।
শিল্প নির্মাণে ফেরদৌসী মজুমদার এক বিস্ময়, এক প্রেরণার নাম। তার সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞ নাট্যকর্মীদের আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করুক। মানুষের কল্যাণে তীব্র স্রোতের মতো ছুটে চলা এই মহীয়সীর সময় গড়িয়ে চলুক নাটকের অগ্রযাত্রায়।
ফেরদৌসী মজুমদার ১৯৪৩ সালের আজকের দিনে (১৮ জুন) বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব