Take a fresh look at your lifestyle.

জন্মদিনে স্মরণঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

0

বাবলু ভট্টাচার্য :

যাদের হাতের যাদুর ছোঁয়া বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিশাল সমৃদ্ধি, যাদের চিন্তা আর সৃষ্টিবৈচিত্র্য বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছে সামনে চলার পথ, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান মানুষ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডলা, দেবীচৌধুরাণী, মৃণালিনী, কৃষ্ণকান্তের উইল, কমলাকান্তের দপ্তর প্রভূতি উপন্যাস ও গল্প আমরা ছোট বেলা থেকে পড়েছি, জেনেছি এবং পাঠ্য বইয়েও কিছু পেয়েছি। সুতরাং তিনি অমর হয়ে আছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উনিশ শতকের বাঙালি সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসীম অবদানের জন্যে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন। তিনিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পূর্বে তার আরও দুই পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন। তারা হলেন শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁঠালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। ছয় বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র ভর্তি হন মেদিনীপুর ইংরেজি বিদ্যালয়। পাঁচ বছর বয়সে স্কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়।

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন।

১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন। এই সময় কাঁঠালপাড়ায় শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন।

হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ইশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরর প্রথম গ্রাজুয়েট রূপে বের হয়ে সমগ্র জীবন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে ইংরেজ সরকারের চাকরি করেন। চাকরি জীবনে দীনবন্ধু মিত্রর সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। সে সময় থেকেই তিনি সাহিত্য রচনায় হাত দেন। তার প্রথম প্রকাশিত রচনা ইংরেজি ভাষায়। তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি লেখকের মত তিনিও প্রথম ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

কিন্তু বিদেশি ভাষায় সাহিত্যচর্চায় কোন পরিতৃপ্তি লাভ করতে না পেরে, তৎকালীন কিছু সংখ্যক ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি মনীষীর বাংলা সাহিত্যচর্চার দৃষ্টান্ত অনুসরণে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা ভাষায় উপন্যাস রচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং স্বল্প সময়েই উপন্যাস শিল্পে সীমাহীন দক্ষতার পরিচয় দেন।

তার প্রথম বাংলা উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এরপর প্রকাশিত হয় : ‘কপালকুন্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯)। এই তিনটি উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথে ইংরেজি-শিক্ষিত মহলে বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের স্বীকৃতি দৃঢ় হয়।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র প্রকাশ করেন ‘বঙ্গদর্শন’ নামের সাময়িক পত্রিকা। সাহিত্য সৃষ্টি এবং সাহিত্য সমালোচনা উভয়ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গদর্শন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বঙ্কিমচন্দ্র তার সাহিত্যিক জীবনের বাইশ বৎসরে চৌদ্দটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। সেগুলোর নাম : দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৯৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), রাধারাণী (১৮৭৫), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮১), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪) ও সীতারাম (১৮৮৭)।

উপন্যাস রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের রোমান্স-আশ্রয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাসের আদর্শের অনুসারী ছিলেন: আবার তিনি সামাজিক-পারিবারিক কথাসাহিত্যের আদর্শেও কতিপয় উপন্যাস রচনা করেন। এ সব উপন্যাসে বাঙালির অতীত ইতিহাস যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি ব্যক্ত হয়েছে সমকালীন সমাজজীবনের কথা।

বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব রচনারীতির মধ্যে অসাধারণ মৌলিকতা অনবদ্য বৈশিষ্ট্য সহকারে প্রকাশ পেয়েছে- তাই তার জন্য এনেছে বাংলা সাহিত্যে সাহিত্য সম্রাটের আসন। একান্ত সহৃদয়তা সহকারে পাঠকের মনোরঞ্জনের দিকে দৃষ্টি রেখে তিনি গল্পরস সৃষ্টি করেছেন। তার ভাষা ভাবের উপযোগী ও অনুগত, ভাবকে ছাড়িয়ে স্বাধীনভাবে প্রকাশের নিদর্শন তাতে নেই। তিনি বিদ্যাসাগরের প্রবর্তিত সুললিত গদ্যভঙ্গিতে নমনীয়তা ও সরসতা সঞ্চার করে বাংলা গদ্যকে সকল বিষয় ভাব রসের বাহন করে তুলেছেন। তার আমল থেকেই মুখের ভাষা ও মনের কথার মধ্যে আর বড় বেশি ব্যবধান থাকেনি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮ এপ্রিল, ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের আজকের দিনে (২৬ জুন) চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

Leave A Reply

Your email address will not be published.