Take a fresh look at your lifestyle.

স্কুল শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে কার্যক্রম!

মেহেরপুরে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা

0

দিলরুবা খাতুন, মেহেরপুর :
১৪ কোটি টাকার আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পত্র চালাচালি যুদ্ধ হয়েছে সরকারের দুটি বিভাগে। মেহেরপুরে সরকারের শিক্ষা বিভাগের সাথে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান নিয়ে পত্র চালাচালি যুদ্ধে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর কাছে হার মেনেছে জেলা শিক্ষা বিভাগ। জেলা শিক্ষা বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মেহেরপুরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার ১.৫% হিসেবে ২৪৩ জন। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো মেনে নিতে পারেনি এই পরিসংখ্যান। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো নিজস্ব লোকবল দিয়ে পরিচালিত পরিসংখ্যানে মেহেরপুর জেলায় ঝরে পড়েছে ৮১২৮ জন। জেলা শিক্ষা বিভাগের পুনঃজরিপে ওই ৮১২৮ জন থেকে ৭৬২৮ জন ঝরে পড়েনি বলে শনাক্ত করেছে।

মেহেরপুরে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্প শুরু হয়েছে। ঝড়ে পড়া শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১০টি কেন্দ্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে স্কুলে শিক্ষার্থী নেয়া হয়েছে নিকটবর্তী সরকারি-বেসরকারি স্কুল থেকে। জেলা শিক্ষা বিভাগের পরিসংখ্যান হিসেবে জেলায় ২০২১ সালে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার ১.৫% হিসেবে ঝরে পড়েছে ২৪৩ জন। এই রিপোর্ট উপেক্ষা করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো ঝরে পড়া শিক্ষার্থী দেখিয়েছে ৮১২৮ জন। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ওই পরিসংখ্যানের প্রতি জেলা শিক্ষা বিভাগের আপত্তি আমলে নেয়া হয়নি প্রকল্প বাস্তবায়নে। মেহেরপুর জেলায় ২১০টি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রে ৬৩০০ জনকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, যা জেলা শিক্ষা বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য মানব উন্নয়ন কেন্দ্র (মউক) নির্বাচিত হয়।

অনিয়ম-দুর্নীতি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঝরে পড়া নয়, এমন শিক্ষার্থীদের দেখিয়ে উপজেলার ২০টি ইউনিয়নে ২১০টি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিকটবর্তী সরকারি-বেসরকারি ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে বিভিন্ন বাড়ির বারান্দায়, বাড়ির ছাদে, গাছের নিচে। এসব উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্রে সিকিভাগ শিক্ষার্থীও উপস্থিত থাকেনা। শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে ৩টি করে খাতা দেয়ার কথা থাকলেও গত ৯ মাসের ৬ মাস খাতা দেয়া হয়নি। প্রতিটি খাতার দাম ২৫ টাকা হিসেবে না দেয়া খাতার মূল্য দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। প্রতি কেন্দ্রে বসার জন্য ৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি করে ম্যাট থাকার কথা। ২১০ কেন্দ্রের ম্যাটের দাম পড়ে ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু ম্যাটের বদলে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ একশ’ টাকা দামের পাটি পেড়ে বসতে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে বৈদ্যুতিক পাখা থাকার কথা থাকলেও কোনো স্কুলে পাখা ঝুলতে দেখা যায়নি। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পতাকা স্ট্যান্ড নেই। শিক্ষার্র্থীদের জন্য প্রতিবছর ড্রেস দেয়ার কথা। গত ৯ মাসে দেয়া হয়নি কোনো ড্রেস। নানা সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের মাসিক ভাতা জনপ্রতি ১২০ টাকা করে। কিন্তু এপর্যন্ত কোনো ভাতা দেয়া হয়নি।

মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী উপজেলায় ঝড়ে পড়া শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে ২৫-৩০ জন করে শিক্ষার্থী নিয়ে ২১০ কেন্দ্রে ৬৩০০ শিক্ষার্থী থাকার কথা। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত স্কুল চালু রাখার নিয়ম করা হলেও সেই নিয়ম মানা হয় না। সরেজমিনে কোনো কেন্দ্রেই ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী দেখা যায়নি। যে কজন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে তাদের অনেকেই নিকটবর্তী স্কুল কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

সদর উপজেলার বাজিতপুর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রটি করা হয়েছে শালিকা গ্রামে মনিরুল ইসলামের বাড়িতে। দুদিন ওই স্কুলে গিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহানাজ পারভিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে জানান, বাবার অসুস্থতার কারণে তিনি দুদিনের ছুটিতে আছেন। সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের শোলমারি গ্রামে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ১৪ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেও কেন্দ্রের শিক্ষক তানিয়া খাতুনের দেখা মেলেনি। তানিয়া ওই গ্রামের গৃহবধু। সাংবাদিকদের উপস্থিতির খবর পেয়ে কেন্দ্রে ছুটে এসে জানান, বাড়িতে একটু কাজের কারণে আসতে দেরি হয়ে গেল। তিনি বিদ্যালয় প্রসঙ্গে কোনো কথা বলতে চাননি।

জেলা শহরের উপকন্ঠে বামনপাড়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রটি করা হয়েছে জেসমিন আহমেদ বুলুর বাড়ির একচিলতে বারান্দাতে। সেখানে সাকুল্যে ১০ জন শিক্ষার্থী বসতে পারে। সরেজমিনে উপস্থিত দেখা যায় ৯ জনের। এরমধ্যে সাব্বির হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী পাশের বামনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এবং নুর হোসেন নামের আরেক শিক্ষার্থী শিশুশিক্ষা স্কুলের ২য় শ্রেণির ছাত্র বলে স্বীকার করে। অন্যরা বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে। স্কুলের শিক্ষক আফসানা ফেরদৌস জানান, ওরা দুজন পাশের স্কুলের ছাত্র। এখানে অতিরিক্ত শিক্ষা পেতে প্রতিদিন আসে।

মানব উন্নয়ন কেন্দ্র (মউক) এর নির্বাহী পরিচালক আশাদুজ্জামান সেলিম জানান, প্রতিটি কেন্দ্র নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি স্কুলের কোনো শিক্ষার্থী তাদের কেন্দ্রে নেই।

মেহেরপুর সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আফিল উদ্দীন জানান, আমরা মন্ত্রণালয়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর যে পরিসংখ্যান দিয়েছিলাম সে পরিসংখ্যান উপেক্ষা করা হয়েছে। এর বাইরে তিনি কথা বলতে চাননি।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর মেহেরপুরের সহকারি পরিচালক কবির উদ্দীন মোল্লা বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার নামে সরকারি অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থী কম এমন অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযোগ সত্য হলে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হবে।

জেলা শিক্ষা অফিসার ভ‚পেষ রঞ্জন রায় জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বইসহ আনুষঙ্গিক সুবিধার কারণে ঝরে পড়া কমেছে। কিন্তু উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর নিজস্ব পরিসংখ্যানে ঝরে পড়া বেশি দেখানো হয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পরিসংখ্যানে আপত্তি দিয়েছি। আমাদের আপত্তি আমলে নেয়া হয়নি। এ কারণে সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থী উপানুষ্ঠানিক কেন্দ্রে গেলে আমরা আপত্তি করিনা। সত্যিকথা বলা ঝুঁকি হয়ে পড়েছে।

মানব উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক আশাদুজ্জামান সেলিম জানান, আমাদের মন্ত্রী এলাকার নিরক্ষরতা দুরিকরণে বিনা খরচে প্রকল্পটি পেতে সহায়তা করেছেন। আমরা সততার সাথে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.