নওয়াপাড়ায় সিন্ডিকেটের কবলে কয়লা
দাম দ্বিগুণ, ওজন বাড়াতে পানি বালু মাটি মেশানো হচ্ছে!
শাহীন আহমেদ, অভয়নগর :
ইটভাটার ভরা মৌসুমে ভাটার অনিবার্য উপাদান কয়লার দাম লাগাম ছেড়েছে। ডলার সংকটকে পুঁজি করে আমদানিকারকরা কয়লার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার অসাধু ব্যবসায়ীরা কয়লার সাথে পানি, বালু মিশিয়ে অনৈতিক কারবার করছেন বলে অভিযোগ করেছেন ইটভাটা মালিকরা। কিন্তু এসব বিষয়ে উপজেলা পর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো অফিস না থাকায় প্রশাসনের কিছুই করার নেই বলে সাফ জানিয়েছেন দেশের অন্যতম কয়লার জোগানদাতা অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেজবাহ উদ্দীন।
আমদানিকারকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স নিয়ে আমদানি করেন। এক্ষেত্রে মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের কিছুই করার থাকে না। এ সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্টও আমাদের কাছে নেই বলে দেখভালের কোনো নিয়মও আমাদের নেই।
– মেজবাহ উদ্দিন, ইউএনও, অভয়নগর
সূত্র জানায়, প্রতিবছর দেশে কয়লার চাহিদা ৩০ লাখ টন। এর মধ্যে নওয়াপাড়া বন্দর দিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অর্ধেকের বেশি ১৭ লাখ টন কয়লা আমদানি হয়ে থাকে। এসব কয়লা ২৭টি জেলায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু ডলার সংকটে এবছর এলসি তেমন না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারকরা। এ কারণে মাত্র ৬-৭ লাখ টন কয়লা আমদানি করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এরইমধ্যে কয়লার দাম প্রতিটন ২৯ হাজার থেকে ৩৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত মৌসুমেও প্রতিটন ১৫-১৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। পরে দাম বাড়লেও তা ১৮-১৯ হাজার টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গতমাস থেকে এ দর ছাড়িয়ে বর্তমানে ২৫ হাজার থেকে ৩৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ইট উৎপাদনে যাচ্ছেন না ইটভাটা মালিকরা। এতে কর্মহীনও হয়ে পড়েছে ইট উৎপাদন শ্রমিকরা। আবার কয়লার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ইটের ওপর। সবধরনের ইট প্রতি হাজারে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে স্থানীয় আবাসন খাতসহ উন্নয়ন প্রকল্প কাজের ঠিকাদাররাও বিপাকে পড়েছেন।
নওয়াপাড়ার ইটভাটা মালিক নূর ইসলাম বলেন, কয়লার বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে। কয়লার দাম গতবারের তুলনায় এবার দ্বিগুণ। কাঠ দিয়ে ইট পোড়াতে হবে। তা না হলে লোকসান কাটাতে পারব না। ইট প্রস্তুতকারক সিটি টু ব্রিকসের মালিক নাজির উদ্দিন বলেন, কয়লার মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার ভাটাতে ইট উৎপাদন করতে পারছি না। তবে বেঁচে থাকার তাগিদে লোকসান হলেও অল্প কয়লা কিনে একটি ভাটায় আগুন দিয়েছি।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সরকার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সাইদ সরকার বলেন, আমাদের কয়লার সব ডিও বিক্রি হয়ে গেছে। যারা কিনেছে তাদের কাছে কম দামে কয়লা পাওয়া যাবে। আমাদের কাছ থেকে নিলে দাম পড়বে ২৯ হাজার টাকা।
যশোর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি কাজী নাজির আহমেদ মুন্নু বলেন, কয়লার দাম অস্বাভাবিক। ৩০ হাজারের বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মাত্র ১০ জনের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ। এই সিন্ডিকেটের কাছে আমরা জিম্মি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ওজন বাড়াতে কয়লায় পানি মেশানো হচ্ছে। আবার যেখানে কয়লা রাখা হয়, সেখান থেকে এস্কেভেটর দিয়ে কয়লা ট্রাকে তোলার সময় বালু আর মাটি মিশিয়ে তোলা হয়। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। তিনি অবশ্য ডলারের সংকটে এলসি খোলা কম হওয়ায় কয়লা আমদানি কম হচ্ছে বলে স্বীকার করেন।
নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট, খাদ্যশস্য ও কয়লা আমদানিকারক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল হোসেন বলেন, এবছর ২২ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হলেও পুরানো কয়লা যাদের আছে, তারা ২৯ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে। আর নতুন যারা আমদানি করবে, তারা তো আরও বেশি দামে বিক্রি করবে। বিশেষ করে ডলারের দাম না কমলে এবার কয়লা সেভাবে আমদানিই হবে না। সংকট আরও বাড়বে। কয়লায় পানি এবং ময়লা মেশানোর অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। এখানে আগে কখনও এমন হয়নি, এবারই প্রথম দেখছি। আমি নিজেও কয়লা কিনে ঠকেছি। সমিতির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে।
কয়লার বেপরোয়া দাম নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক উদ্যোগের ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মেজবাহ উদ্দীন বলেন, আমদানিকারকরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স নিয়ে আমদানি করেন। এক্ষেত্রে মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের কিছুই করার থাকে না। এ সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্টও আমাদের কাছে নেই বলে দেখভালের কোনো নিয়মও আমাদের নেই।