Take a fresh look at your lifestyle.

চীনে করোনা থামাবেন নাকি বিক্ষোভ, কী করবেন সি?

0

সংবাদ কক্ষ

মাত্র পাঁচ সপ্তাহ আগেই ইতিহাস গড়ে তৃতীয় মেয়াদে চীনের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন সি চিনপিং। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসও ব্যাপক আয়োজনে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। তারপর দেড় মাসও পেরোয়নি, সির পাহাড়সম কর্তৃত্বে ফাটল ধরার মতো ঘটনা ঘটেছে। চীনজুড়ে দেখা দিয়েছে বিক্ষোভ; সির পদত্যাগ দাবি করছে বিক্ষুব্ধ জনতা। দৃশ্যত কোনো সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়াই হাজার হাজার মানুষের এভাবে রাস্তায় নেমে আসা এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমজুড়ে সি বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া চীনা প্রেসিডেন্টের জন্য হঠাৎ ভূমিকম্পের মতোই বিরাট এক ধাক্কা।

বিক্ষোভের সূত্রপাত লকডাউনকে কেন্দ্র করে। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় চীনের অনেক এলাকায় নতুন করে সম্প্রতি লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সি সরকার। এর প্রতিবাদে গতকাল রোববার রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন দেশটির সাধারণ জনগণ। তারা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। সাংহাইসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। প্রকাশ্যে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবি করার নজির চীনে নেই বললেই চলে। সেখানে বিক্ষোভকারীদের ‘লকডাউন চাই না, স্বাধীনতা চাই’, ‘হয় স্বাধীনতা দাও না হয় মৃত্যু দাও’, ‘সি চিনপিং পদত্যাগ করো, কমিউনিস্ট পার্টি পদত্যাগ করো’ ইত্যাদি নানান স্লোগান দিতে দেখা গেছে। সংগত কারণে এ ঘটনাকে নজিরবিহীন হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

শুধু রাস্তায় নয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। বেইজিং ও নানজিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের উরুমকি শহরেও হাজার হাজার মানুষকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। গত বৃহস্পতিবার উরুমকিতে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এরপর থেকেই মূলত শহরটির বিক্ষুব্ধ জনতা লকডাউন-বিরোধী স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে আসে। অনেকেরই অভিযোগ, অগ্নিকাণ্ডের শিকার ভবনটি লকডাউনের কারণে আংশিকভাবে তালাবদ্ধ থাকায় বাসিন্দারা সময়মতো বের হতে পারেনি। এ ছাড়া দগ্ধদের ঠিক সময়ে হাসপাতালে নেওয়াও সম্ভব হয়নি। যদি লাকডাউন না থাকত, এত হতাহত হতো না।

 

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছে, এ মৃত্যুর সঙ্গে কোভিডের নিষেধাজ্ঞার কোনো যোগসূত্র নেই। এমনকি তারা ‘জিরো কোভিড পলিসি’ থেকেও সরে আসবে না বলে জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীরা ‘লকডাউন তুলে নাও’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। একপর্যায়ে একটি বড় অংশ সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করে। এ সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের পতন দাবি করে বিক্ষোভকারীরা। প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি চীনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটি বিরল প্রকাশ্য প্রতিবাদ।

চীনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সে সব নিয়ন্ত্রণের ফাঁক ফোকর গলে যত ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, তা সি প্রশাসনের জন্য অশনিসংকেত। উরুমকিতে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এরপর থেকেই মূলত শহরটির বিক্ষুব্ধ জনতা লকডাউনবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে আসেউরুমকিতে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। এরপর থেকেই মূলত শহরটির বিক্ষুব্ধ জনতা লকডাউনবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে আসে। ছবি: টুইটার

মাস দুয়েক আগে ইরানেও শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনি নামের এক কুর্দি তরুণীর মৃত্যুর পর শুরু হওয়া বিক্ষোভ ক্রমশ সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে। ইরানের এ বিক্ষোভের সঙ্গে চীনের বিক্ষোভের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিল না থাকলেও দুটির মূল সুর প্রায় একই। তা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ।

অনেক বিশ্লেষকই এ বিক্ষোভের সঙ্গে ১৯৮৯ সালের তিয়ানমেন স্কয়ারের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছেন। গত দুই দশক ধরে চীনে যেভাবে ভিন্নমতকে দমন করা হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক ধারাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, তাতে এ ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক বর্তমান বিক্ষোভকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। প্রথমত, ১৯৮৯ সালের বিক্ষোভ মূলত বেইজিংয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমান বিক্ষোভ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, সির শুধু ‘জিরো কোভিড’ নীতিই জনগণকে রাস্তায় নামানোর জন্য যথেষ্ট। এর সঙ্গে সির সরকার কীভাবে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখছে, সে সব প্রশ্ন জনমনে উঠলে তো সোনায় সোহাগা।

বর্তমানে সির জন্য শিরে সংক্রান্তি হয়ে যে বিপদটি দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় নীতির ওপর স্থানীয় কর্মকর্তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। করোনার দোহাই দিয়ে তিন বছর ধরে লকডাউনবন্দি করে রাখা জনগণ আর মেনে নিতে পারছে না। এর মধ্যে কাতার বিশ্বকাপে হাজার হাজার মাস্কবিহীন দর্শক তাদের করোনা বিরোধী হতে আরও উসকে দিয়েছে।

চীনা সরকার বলছে, জিরো কোভিড নীতির বিকল্প নেই। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর তুলনায় চীনের মৃত্যু ৬ হাজারের নিচে রাখার মাধ্যমে মূলত অর্থনীতি বাঁচানোর চেয়ে জীবন বাঁচানোকেই বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু চীনের জনগণ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তারা আর লকডাউন চায় না। জনগণের এ চাওয়াকে আমলে নিয়ে গত ১১ নভেম্বর চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ নীতি পরিমার্জিত করে নতুন করে ২০ দফা পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। সেই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কোয়ারেন্টাইনের সময়কাল কমিয়ে আনা, করোনামুক্ত নিশ্চিত হওয়াদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করা ইত্যাদি। সরকার আশা করেছিল, এতে জনগণ আশান্বিত হবে এবং চীনা প্রবৃদ্ধি আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।

সরকারের এ নতুন পরিকল্পনা আশানুরূপ ফলের মুখ দেখেনি। গত বুধবারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। আর গতকাল রোববারের হিসাব অনুযায়ী, সংক্রমণ ৪০ হাজার ছুঁয়েছে। এটি প্রমাণ করে, চীনের প্রতিটি অঞ্চলে করোনার প্রাদুর্ভাব ক্রমশ বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বেইজিং, গুয়াংজু এবং তিয়ানজিনসহ অন্যান্য শহরে দৈনন্দিন জীবন ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে চীন সরকার। রাজধানী থেকে ১১ কিলোমিটার দূরের শহর শিজিয়াজুয়াংয়ে বিধিনিষেধ শিথিল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেখানেও গত কয়েক দিনে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চীন যদি জিরো কোভিড নীতি থেকে সরে আসে, তবে করোনার এ ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ মোকাবিলা করা দুষ্কর হয়ে পড়বে। কারণ চীনের বয়স্ক মানুষদের করোনার টিকা খুব একটা দেওয়া হয়নি।

সি এখন কী করবেন? করোনা থামাবেন না কি বিক্ষোভ থামাবেন? তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ভিন্ন মত সহ্য করার নজির নেই। সন্দেহ নেই, তিনি এ বিক্ষোভকে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও নিজের কর্তৃত্বের জন্যই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। ২০১৩ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরে এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আদর্শিক আধিপত্য রক্ষার ব্যাপারে তিনি খুবই সতর্ক। একবার আদর্শগত আধিপত্য ছুটে গেলে, অন্যান্য আধিপত্য রক্ষা করা কঠিন বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নিজেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে বা সেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফাটল ধরেছে কি না তা এখনই নিশ্চিত করা বলা যাচ্ছে না। কর্তৃত্ব রক্ষায় সি চিনপিং হংকংয়ে যে নির্মম কৌশল ব্যবহার করেন, তা এখন চীনেও ব্যবহার করবেন বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক।

তবে ঘটনা যাই ঘটুক, বর্তমান বিক্ষোভ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সির আধিপত্যের ওপর একটা বড় চপেটাঘাত—এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি এটাও বলা যায়, চীনের উত্থান, পশ্চিমের পতন আর ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা ধরে রাখতে সি চিনপিং সব রকমের বিপজ্জনক ঝুঁকির বাইরে থাকতে মরণপণ চেষ্টা করে যাবেন।

সূত্রঃ আজকের পত্রিকা 

Leave A Reply

Your email address will not be published.