যশোরে ৮ মাস ধরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মী উদ্ধার
গভীর রাতে ৯৯৯ ফোন, গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী পুলিশ হেফাজতে
প্রতিবেদক :
যশোরে ৮ মাস ধরে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার এক শিশু গৃহকর্মীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে বুধবার (১২ এপ্রিল) মধ্যরাতে যশোরের ঘোপ এলাকা থেকে ঐ শিশুকে উদ্ধার করা হয়। নির্যাতনের শিকার ফিহা মনি (১৩) দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার মাঝপাড়া এলাকার মৃত আবুল হোসেনের মেয়ে। সে গত ৯ মাস ধরে যশোর শহরের ঘোপ এলাকায় সিনজেনটা কোম্পানির সেলস ইউনিট ম্যানেজার সরকার শামীম আহমেদ অংকুরের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতো।
পুলিশ উদ্ধারের পর ফিহা মনিকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। একইসাথে গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে হাসপাতালের বেডে চিকিৎসাধীন শিশু ফিহা মনি তার গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। ফিহা মনি জানায়, ‘আমাকে সব কাজ সময় বেঁধে দিতো। সেই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে রুটি বানানো বেলন, খুন্তি দিয়ে মারতো। মাঝেমধ্যে রেঞ্জ প্লায়ার্স দিয়ে পায়ের নখ উঠিয়ে দিত। এভাবেই আমাকে গত ৮ মাস ধরে নির্যাতন করা হয়েছে।’
পুলিশ ও পরিবারসূত্রে জানাগেছে, কয়েক বছর আগে ফিহা মনির বাবা মারা গেলে তার মা আবার বিয়ে করেন। তখন থেকে ফিহা মনি পার্শ্ববর্তী গ্রামে তার নানী বাড়িতে থাকতো। পরে তার মায়ের পরিচিত একজন সরকার শামীম আহমেদের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে দিয়ে দেন। ৯ মাস আগে ফিহা মনিকে শামীম আহমেদ যশোরে ভাড়ার বাড়িতে নিয়ে আসেন। যশোরে একমাস তারা ফিহার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলেও পরবর্তী ৮ মাস ধরে নির্যাতন করে চলেছে।
বৃহস্পতিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, একটি ছেঁড়া রঙচটা ফ্রক পরে হাসপাতালের বেডে ভাত খাচ্ছে শিশু ফিহা মনি। তার শরীরে বিভিন্ন স্থানে ক্ষতচিহ্ন। পায়ে আঘাত করার কারণে দুই পা ভাজ করতে পারছে না। দুই পা সোজা করে রেখে ভাত খেতে হচ্ছে।
পাশের বেডেই এক রোগীর স্বজন বলেন, এই শিশুটির নির্যাতনের ক্ষত দেখে শিউরে উঠি। সকালে কিছু খায়নি। এর সাথে কোনো স্বজন না থাকায় আমাদের বাড়ি থেকে আনা খাবার দিয়েছি; সেগুলোই খাচ্ছে।
খাওয়া শেষ হলে ফিহা মনি জানায়, ‘আমাকে সময় বেঁধে গৃহস্থালির সব কাজ করতো হতো। কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, থালা বাসন পরিষ্কার, মসলা বাটাসহ সব কাজ করতো হতো। কোনো কাজে একটু বেশি সময় লাগলে রুটি বানানো বেলন, ডিসের মোটা তার ও সেলাই-রেঞ্জ দিয়ে মারতো গৃহকর্ত্রী জান্নাত জুঁই ও তার স্বামী সরকার শামীম আহমেদ।
‘সর্বশেষ বুধবার সন্ধ্যায় ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনতে একটু দেরি হওয়ায় বেলন দিয়ে বেদম পিটুনি দেওয়া হয়। চোখে রক্ত জমে যায়। সেলাই রেঞ্জ দিয়ে পায়ের নক থেতলে দেয়। চিৎকার করলে মেরে ফেলার ভয় দেয়। ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারি না। রাতে দরজা খোলার সময় পাশে বাড়ির একজন আমাকে দেখে ঘটনা জানতে চাইলে, আমি বলে দিই আমাকে মেরেছে। পরে রাতে পুলিশ এসে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে।’
যশোর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, শিশুটিকে রাত ১টা ১০ মিনিটে ভর্তি করা হয়। তিনি জানান, শিশুটির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ভোতা অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। চোখে, মাথা, পায়ের তলাতে আঘাত করা হয়েছে। প্রথমে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি করা হলেও মেয়েটি এখন শঙ্কামুক্ত।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন বলেন, গভীর রাতে ৯৯৯-এ আমাদের কাছে ফোন আসে গৃহকর্ত্রী এক গৃহকর্মী শিশুকে নির্যাতন করছে। ফোন পাওয়ার পরেই ঘটনাস্থলে যেয়ে ঘটনার সত্যতা পায় পুলিশ। শিশুটিকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি এবং অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তাকে আটক করা হয়েছে। এই ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। তিনি জানান, ঐ বাসাবাড়িতে নির্যাতনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা বেলন ও কিছু তার উদ্ধার করেছি।