Take a fresh look at your lifestyle.

পহেলা বৈশাখ এবং আমাদের সংস্কৃতি

0

প্রতিবেদক :
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা বর্ষ ১৪২৯। বাংলার চিরায়ত উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি ছিল গতকাল। চৈত্র মাসের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’— এভাবে বিদায়ী সূর্যের কাছে এ আহ্বান জানায় বাঙালি।

পয়লা বৈশাখ আমাদের সকল সঙ্কীর্ণতা, কুপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়তে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের মনের ভেতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণে আমাদের মধ্যে এই স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। এ উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। এছাড়া আমানি, রাজপুণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান যা আগের দিনে মাস জুড়ে চলতো। বাংলা নববষের্র সূচনা মুসলমানদের হাতে। হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে বাংলার কৃষকদের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।

মূলত মুঘল শাসনামলে হিজরি সনের ভিত্তিতে এ দেশে বছর গণনা হতো। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। অধিকন্তু কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়।

বাংলা সন প্রবর্তন থেকেই সাধারণ মানুষের সাথে এ সনের পরিচয় সুগভীর। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হলে আজ বাংলা কত তারিখ, তারা হাতের আঙ্গুলে গুণে তা বলে দেবেন। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর গুরুত্ব হচ্ছে হিজরি সন। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে। এ নিয়মই আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। ইংরেজ শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে ‘নববর্ষ’ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তৎপরবর্তীকালের ঘটনা বাংলা ‘নববর্ষ’ উদযাপনকে প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত করেছে। অবশ্যই সাম্প্রতিককালের ‘নববর্ষ’ বা ‘বর্ষবরণ’ ও আগের দিনের ‘নববর্ষ’ বা বর্ষবরণের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট।

বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ের ‘নববর্ষ’ উদযাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে প্রকৃত সুখ আসে না।

আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিম নিবিড় পল্লীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব অতল গহ্বনে হারিয়ে যায়। শিল্পপতি, চাকরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের গহ্বনে পিষ্ট বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছে বাঙালি কৃষকের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কেন্দ্র করে। বাংলা নববর্ষের মূল উৎস কৃষক ও কৃষি।

বাংলা ‘নববর্ষ’ কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে বৈশাখী মেলা বসে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, খেলনা ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ে মেলায়। আগের দিনে মেলায় প্রদর্শনী হতো বাঁশের বেতের তৈজষ পত্র, নানা জাতের খেলনা সামগ্রি, নারকেল মুড়কিসহ কত কি থাকে মেলায় তার ইয়ত্তা নেই। মেলার সময় নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর এমন কি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইয়র আসতো বাপের বাড়ি। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো।

এমনিভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাংলার গ্রামে গ্রামে আনন্দের ধুম পড়ে যেতো। বৈশাখী মেলার আগের দিন লাঙ্গল জোয়াল মইসহ বিভিন্ন কৃষি সরঞ্জামাদি, গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় মাটির হাড়ি-পাতিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র, শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেলায় মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদি দ্রব্যও বেচা-কেনা হতো। এছাড়া জুড়ি-বুন্দি জিলাপি রসগোল্লাসহ মুখরোচক খাবারের সমারোহ ছিল বেশ চমৎকার।

প্রাচীন রীতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবেই জড়িত শুভ হালখাতা। প্রত্যেক চাষাবাদ চৈত্র মাসের শেষ দিনে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরবর্তীতে তা ব্যবসায়িক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসবগুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো ‘নববর্ষে’ হালখাতার হিড়িক পড়ে প্রত্যেক গ্রামগঞ্জে।

বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। আকড়িয়ে ধরতে হবে বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতিকে। বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশি সংস্কৃতিতে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের অপসংস্কৃতি হতে প্রতিহত করতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। তাই অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি। তাহলেই আমাদের বাঙালির ‘নববর্ষ’ উদযাপন সার্থক হবে।

নদী মিশে যায় সাগরে। ম্রিয়মান ছায়া পেছনে ফেলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনও পৌঁছে যায় রাতের অন্ধকারে। অস্তমিত হয় শেষ বিকেলের সূর্য। সময় এমনি হয়! সেই সময়ের পথ ধরে পুরনো হয়ে যায় আরো একটি বছর। পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া দুর্বিষহ ঘটনা, অশ্রু ঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক। বৈশাখের অগ্নিস্নানে পুরাতন বৎসরে সংক্রমিত করোনা ভাইরাসের আবর্জনাও দূর হয়ে যাক।

সবাইকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.