নওয়াপাড়ায় জাহাজ ও কার্গোর পণ্য চুরির হিড়িক
মাস্টার ড্রাইভার এবং সুকানি ও শ্রমিক মিলেমিশে চুরির অভিযানে
অভয়নগর প্রতিনিধি :
যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় নৌবন্দরকে ঘিরে পণ্যচুরির শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। নদীবন্দরের জাহাজ থেকে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে মালামাল চুরির মহোৎসব। একশ্রেণির মাস্টার ড্রাইভার এবং সুকানি ও শ্রমিকদের যোগসাজসে চলে চুরির অভিযান।
ব্যবসায়ীরা জানান, সড়ক, রেল ও নদীপথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নব্বই দশকের শুরুতে নওয়াপাড়ায় সার, খাদ্যশস্য ও সিমেন্ট ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বর্তমানে প্রতিবছর ৪ হাজারের বেশি জাহাজে ২০ লাখ টনের অধিক পণ্য আসছে এ বন্দরে। এতে করে এলাকাটি পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম বড় বিপণন কেন্দ্রে। আমদানি করা সার ও খাদ্যশস্য চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে বড় জাহাজ থেকে খালাসের পর তা ছোট বার্জ ও কার্গোতে করে নদীপথে নওয়াপাড়া বন্দরে আনা হয়। এসব পণ্য সড়ক ও নদীপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
সূত্র জানায়, নওয়াপাড়ার চেঙ্গুটিয়া থেকে ফুলতলা পর্যন্ত শতাধিক ঘাট পয়েন্টে জাহাজের মালামাল খালাসের অপেক্ষায় থাকে দীর্ঘদিন। এক একটি জাহাজকে প্রায় ১০-১২ দিন বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। সংঘবদ্ধ চক্র প্রতিরাতে এসব কার্গো জাহাজ থেকে শ্রমিকদের যোগসাজসে বিভিন্ন প্রকার মালামাল হাতিয়ে নেয়। এসব মালামালের মধ্যে রয়েছে ডিজেল, মবিল, সার, সিমেন্ট, কয়লা, গম, ভুট্টাসহ জাহাজের মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও লোহালক্কড়। এ কাজে সহযোগিতা করে স্ব স্ব জাহাজের একশ্রেণির অসৎ মাস্টার-ড্রাইভার ও সুকানি এবং ঘাটশ্রমিক।
সূত্র জানায়, তিনটি গ্রুপে বিভক্ত চক্রটি দীর্ঘদিন এ অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। এদের মধ্যে নওয়াপাড়ায় একটি এবং তালতলায় দুটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে তারা বিভিন্ন ঘাটে অভিযানে নামে। চেঙ্গুটিয়া থেক ফুলতলা পর্যন্ত প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জাহাজে তাদের অভিযান চলে প্রতিরাতে। বর্তমানে তাদের প্রধান আকর্ষণ জাহাজের ডিজেল ও মবিল। জাহাজ থেকে ৯০ টাকা লিটার দরে ডিজেল কিনে বাইরে তা ১শ’ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি করে। পাশাপাশি মবিল ১শ’ টাকা থেকে ১১০ টাকা দরে কিনে বাইরে ১৫০-১৬০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকে। অন্যান্য মালামালের ক্ষেত্রে তারা জাহাজে কর্তব্যরত স্টাফদের জিম্মি করে এ কাজ করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় হওয়ায় এই চক্রের বিরুদ্ধে তারা মুখ খুলতে সাহস পায়না। ফলে অনায়াসে জাহাজ থেকে বিভিন্ন প্রকার মালামাল নিয়ে তারা স্থান ত্যাগ করে। থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে তারা দীর্ঘদিন এ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নওয়াপাড়া সার, সিমেন্ট, কয়লা, পাথর, গম, ভুট্টা, ডালসহ খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ জালাল হোসেন বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই এ বন্দরের মালামাল চুরি হচ্ছে। চুরির কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। পথেও হয়। নামানোর সময়ও হয়। তবে আফিল গ্রæপের একটি বড় চালান লুট হবার পর প্রশাসনের তৎপতায় সেটা উদ্ধার করা গেছে।
নোয়াপাড়া ট্রেডার্সের প্রধান (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) মিজানুর রহমান জনি বলেন, মোংলা পোর্ট থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত দুর্বত্তরা ওৎ পেতে থাকে। যেখানে যেভাবে পারছে মালামাল চুরি করছে। কখনও হুমকি, কখনও প্রলোভন আবার কখনও জাহাজের কর্মচারী সেজে অন্যদের অজ্ঞান করে মালামাল লুট করে। আমরা কখনও কখনও নিজস্ব ট্রলার ভাড়া করে নিরাপত্তা দেয়ার চেষ্টা করি। নৌপুলিশ নৌপথের পাহারা নিশ্চিত করতে পারলে আমরা দুর্ভাবনা মুক্ত হতে পারতাম। তিনি আরও বলেন, পণ্য চুরির সাথে খালাসের সাথে জড়িত শ্রমিকরাও যুক্ত থাকে। কিন্তু আমরা তাদের কাছে জিম্মি। ব্যবস্থা নিলেই তারা আপলোড বন্ধ করে দেয়। আর এতে জাহাজ খালি করতে না পারলে ডেমারেজ দিতে হয়।
তবে পণ্য চুরির সাথে শ্রমিকদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন নওয়াপাড়ার সদস্য সচিব নিয়ামুল হক রিকো বলেন, অনেক সময় জাহাজ ভাটায় স্রোতের টানে আসায় যে ডিজেল ‘সেভ’ হয়, তা শ্রমিকরা কিনে নেয়।
বিআইডব্লিউটিএ নওয়াপাড়া নৌবন্দরের উপ-পরিচালক মাসুদ পারভেজ বলেন, নদীপথের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব নৌপুলিশের। আমাদের কাছে চুরি নিয়ে কেউ অভিযোগ দেয় না। এটা আমাদের দায়িত্বও না। তবে বিভিন্ন সভায় জাহাজ থেকে পণ্য চুরির বিষয়টি আলোচনা হয়।
নওয়াপাড়া নৌ-পুলিশের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সবাই আসলে চুরির কথা বলেন। কিন্তু কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। নওয়াপাড়া নৌ-পুলিশের দায়িত্বে থাকা এসআই আতিকুর রহমান বলেন, আমাদের কাছে চুরির অভিযোগ কেউ করেনি। চুরি হলেও জানতে পারছি না।
অভয়নগর থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম শামীম হাসান বলেন, এটা নৌপুলিশের এখতিয়ারভুক্ত। তবে নদী থেকে চোরাইপণ্য বাজারে এনে বিক্রি করা হলে আপনাদের এখতিয়ারভুক্ত হয় কিনা প্রশ্ন করলে বলেন, এমন অভিযোগ আমরা পাইনি।