চলে গেলেন প্রফেসর অসিতবরণ ঘোষ
প্রতিবেদক :
বরেণ্য শিক্ষাবিদ অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর অসিতবরণ ঘোষ বার্ধক্যজনিত কারণে আজ রবিবার (১৩ নভেম্বর) ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় খুলনার একটি হাসপাতালে পরোলোকগমন করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী একপুত্র ও এককন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। রবিবার খুলনার রূপসা মহাশশ্মানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। এর আগে খুলনা মহানগরীর শ্রীঅরবিন্দ সোসাইটির আঙিনায় শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ আনা হয়। এই সোসাইটির সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে আমৃত্য তিনি ৪৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এখানে খুলনার জেলা প্রশাসক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।
১৯৩৬ সালের ৪ আগস্ট যশোর শহরের বাগমারা পাড়ায় অসিতবরণ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রফুল্ল ঘোষ পেশায় আইনজীবী ছিলেন। মা রত্নপ্রভা ঘোষ। ১৯৫৩ সালে যশোরের সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, খুলনার ব্রজলাল কলেজ থেকে আইএসসি এবং যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কঠিন ব্যাধি ও আর্থিক সংকটের কারণে স্নাতকোত্তর পাঠে ছেদ ঘটে। একটি কোম্পানির মাসিক পাঁচশ’ টাকা বেতনের চাকরি প্রত্যাখ্যান করে মাত্র একশ’ টাকা বেতনে তিনি ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার নিজের স্কুলেই শিক্ষকতায় যোগ দেন। তিন বছর শিক্ষকতার পর ১৯৬২ সালে শিক্ষানুরাগী এই ব্যক্তিত্ব উচ্চশিক্ষার জন্য স্কুলের কাজে ইস্তফা দিলে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে স্বেচ্ছায় ছুটি মঞ্জুর করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে দশম স্থান অধিকার করে পুনরায় স্কুলে যোগ দেন। এরপর তিনি ঝিনাইদহের কেশবচন্দ্র, মাগুরা ডিগ্রি কলেজ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন এবং সর্বশেষ সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে অবসরগ্রহণ করেন। কিন্তু শিক্ষকের অবসরে বিশ্বাসী ছিলেন না প্রথাবিরোধী এই শিক্ষাবিদ। প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৯৯৬ সালে তিনি খুলনার শ্রীঅরবিন্দ সোসাইটির আঙিনায় একটি ব্যতিক্রমীধর্মী ল্যাবরেটরি শিশু শিক্ষায়তন অরোতীর্থ বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেন।
আমাদের দেশে শিশুশিক্ষায় প্রবহমান নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য নিরসনে তিনি বিগত দুই যুগ ধরে নানাবিধ কর্মযজ্ঞের আয়োজন ও উদযাপন করে আসেন। এ লক্ষ্যে তিনি ২০০১ সালে খুলনায় ইন্ট্রিগাল চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (আইসিডিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুশিক্ষা মেলার আয়োজন করে তিনি অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেন। তিনিই প্রথম বিশ্বনন্দিত শিশুশিক্ষাবিদ মারিয়া মন্তেসরি প্রণীত গ্রন্থ দ্যা সিক্রেট অব চাইন্ডহুড, হোয়াট ইউ শ্যুড নো অ্যাবাউট ইওর চাইন্ড এবং দি অ্যাবজরবেন্ট মাইন্ড বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন, যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। নোবেল বিজয়ী স্যামুয়েল বেকেট রচিত নাটক অল দ্যাট ফল (সমূহ পতন)-এর সার্থক অনুবাদ তার একটি অসামান্য কাজ। খলিল জিবরানের একাধিক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছেন, যার মধ্যে দ্য ওয়ান্ডারার (সেই পরিব্রাজক) এবং দ্য ম্যাডম্যান (পাগল), স্যান্ড অ্যান্ড ফোম (বালুকা ও ফেনা), দ্য প্রফেট প্রকাশিত এবং সুধীমহলে সমাদৃত হয়েছে। তার মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য রামমোহন এবং ক্রান্তদর্শী শ্রীঅরবিন্দ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একজন কলম সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারে সত্যব্রত ছদ্মনামে তার লেখা কথিকা প্রচার হয়। এছাড়া, ১৯৭১ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তার দুটি নাটিকা স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য মনোনীত হয়। তার একটি রাত্রির তপস্যা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বেতার থেকে বহুবার প্রচারিত হয়। তিনি অতীশ দীপংকর থেকে বঙ্গবন্ধু পর্ষন্ত বাঙালি মনীষার ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার স্বরূপ নির্ণয়ে এবং বর্তমান প্রজন্মের সামনে তা উন্মোচনের লক্ষে তিনি আমৃত্যু কাজ করেছেন।
সাহিত্যে অবদানের জন্য চাঁদের হাট পদক ২০১৫ প্রদানের মাধ্যমে বরেণ্য এই শিক্ষাবিদকে সম্মাননা জানানো হয়। তার মৃত্যুতে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন প্রাক্তন ছাত্র সমিতির আহ্বায়ক রবিউল আলম ও সদস্য সচিব হিমাদ্রী সাহা এবং চাঁদের হাট যশোরের সভাপতি ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রকিব সরদার অপু গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞান এবং পারলৌকিক আত্মার মঙ্গল কামনা করেছেন।