জন্মদিনে স্মরণ : জননী সাহসিকা রমা চৌধুরী
বাবলু ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে তার অবদান। অনেক কষ্ট বুকে চেপে রেখে দেশমাতৃকার জন্যে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। তিনি মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরী। তিনি ১৯৪১ সালের আজকের দিনে (১৪ অক্টোবর) চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/ তবে একলা চল রে …’ কবিগুরুর গানের এই কথাকে নিজের জীবনের চলার পথের আদর্শ ধরে নিয়ে হেঁটেছেন জননী সাহসিকা রমা চৌধুরী। হয়তো খুব কষ্ট বুকে নিয়ে, সমাজের মানুষগুলোর প্রতি গোপন অভিমান নিয়ে, জীবনের প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণা নিয়ে।
ষাটের দশকের শুরুতে একজন বাঙালি নারীর পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করা খুব সাধারণ কোনো ঘটনা ছিল না। তিনি ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী, যিনি এমএ পাস করেছিলেন। পাস করে রমা চৌধুরী বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা পেশাকে। সেই সময়েই নারী স্বাধীনতার, নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রতীক ছিলেন তিনি।
শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধই বদলে দিল সেইসময়ের উজ্জ্বল তরুণী, তিন সন্তানের জননী রমা চৌধুরীর জীবন। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার পোপাদিয়া গ্রামে। সঙ্গে ছিলেন মা আর ছোট তিন সন্তান। স্বামী চলে গিয়েছিলেন ভারতে। এরপরের ইতিহাস খুব বেদনাবহ।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে নিগৃহীত করে, অপমান করে। তারা রমা চৌধুরীকে তার সন্তান ও মায়ের সামনে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে। শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়িঘর পুরো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যাতে কোনোভাবেই এই পরিবারটি বেঁচে না থাকে।
এরপরের ইতিহাস আরও কষ্টের। আরও বেদনার। নিজের সম্ভম হারানোর ভয়ংকর ঘটনাকে আড়াল করে তিনি তিন শিশু সন্তান ও মাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন। জঙ্গলে রাত্রি কাটিয়েছেন। সেসময় তিনি পাননি কোনো আশ্রয়, কোনো সহযোগিতা ও ভালোবাসা। এই সমাজ তাকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। চরম নিগ্রহ ও দারিদ্র্য তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে তছনছ করে দেয়। সাগর, টগর, টুনু পরপর তিন সন্তানকে হারিয়ে তিনি পাথর হয়ে পড়েন।
কিন্তু জীবনতো থেমে থাকেনা। বেঁচে থাকার জন্য শুরু করেন লেখালেখি। ‘একাত্তরের জননী’সহ ১৮টি বই লিখেছেন তিনি। বই লিখেছেন শুধু নয়, জীবিকার প্রয়োজনে এই বই ফেরি করে বেড়িয়েছেন পথে হেঁটে হেঁটে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত শারীরিক কষ্ট ও রোগব্যাধিকে অগ্রাহ্য করে তিনি বই ফেরি করে সংসার চালিয়েছেন।
‘জননী সাহসিকা’ বলে খ্যাত রমা চৌধুরী শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি একজন মা। আর তাই তিন তিনটি সন্তান হারানোর ব্যথা তাঁকে ভেতরে ভেতরে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছিল। এই সমাজের ভালোবাসা না পেয়ে তাঁর সন্তানগুলো সব হারিয়ে গেছে। এই কথা উনি কখনো ভুলেননি। সেজন্য যতো কষ্টই হোক তিনি মাথা নত করেননি কখনো। হাত পাতেননি কারও কাছে।
তিনি খালি পায়ে হাঁটতেন। ৩০বছর উনি খালি পায়ে হেঁটেছেন। তিনি বলতেন, যে মাটিতে আমার সন্তানরা ঘুমিয়ে আছে, সে মাটির উপর দিয়ে আমি জুতো পায়ে হাঁটি কেমন করে?
১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন এই অসম সাহসী নারী, সেই যুদ্ধ তাঁর শেষ হলো ৭৯ বছর বয়সে এসে। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮-তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।