জন্মদিনে স্মরণঃ ফাদার পল দ্যতিয়েন
বাবলু ভট্টাচার্য :
একজন লেখক বাংলায় গল্প লিখছেন অথচ তিনি বাঙালি নন এমনকি ভারতের অধিবাসীও নন সুদূর বেলজিয়ামে তার জন্ম! অদ্ভুত লাগছে না? ভাবছেন ডাহা মিথ্যে? আপনার বিশ্বাস করতে যতই কষ্ট হোক না কেন ফাদার পল দ্যতিয়েন একজন বেলজিয়ান লেখক এবং ধর্মযাজক— যিনি বাঙলা ভাষায় সাহিত্যকীর্তির মাধ্যমেই হয়ে উঠেছিলেন জগৎ-বিখ্যাত।
কলকাতা-শান্তিনিকেতন-বাসন্তী-শ্রীরামপুর ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বাংলা ভাষা মনের মতন করে আয়ত্ব করতে সময় নেন মোটামুটি দশ বছর। তবে তার মধ্যেই দ্যতিয়েন সেই বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন, খুব অল্প সময়েই যিনি উপলব্ধি করে ফেলেন এক সারসত্য- “বাঙালিরা শুধু মনে-প্রাণে নয়, উদরেও ভালোবাসে।”
লালমুখো এই পাদ্রিসাহেব কথা বলতেন বাংলায়। খেতেন বেগুনি-পেঁয়াজি। ব্যবহার করতেন লুঙ্গি-গামছা। শুনতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলকাতায় এলে থাকতেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের কাছেপিঠে কোথাও। বিচিত্র এও, ইনি লিখতেন বাংলা ভাষায়, বাংলা গদ্য।
অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, সেই কত বছর আগে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যানরা তো দিব্যি বাংলা ভাষা-বাংলা গদ্য নিয়ে কাজকর্ম করেছেন, দ্যতিয়েন তাহলে বিচিত্র কীভাবে! নানান ভিনদেশি বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বহুরকম চর্চা করেছেন, ঠিকই। কিন্তু বাংলা ভাষায় মৌলিক রম্য-গদ্য রচনা কেউ করেছেন কি? বোধহয় না।
অবশ্য কেরি-মার্শম্যানদের নিজেদেরই তো বাংলা গদ্যের কাঠামো তৈরি করে নিতে হয়েছিল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শতাব্দী-সমৃদ্ধ ইতিহাস তারা চর্চা করতে পারেননি। ফাদার পল দ্যতিয়েন ছিলেন সেই বাঙালি যিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গিয়েছিলেন তার শ্রাদ্ধবাসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে।
দ্যতিয়েন টানা প্রায় তিন দশক বাঙালিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ আত্মস্থ করেছেন ভালোবেসে। বাংলা ভাষার নিজস্ব সব আটপৌরে প্রয়োগকে সাজিয়ে নিয়েছেন লেখায়।
তার সব লেখাতেই নিজের উপলব্ধির কথা থাকলেও সমস্তটা আসলে সেই বাংলা ও বাঙালি নিয়েই চিন্তাভাবনার ফসল। আর শুধু তো সাহিত্য নয়, এখানকার সমাজ-অর্থনীতি- রাজনীতি এমনকি বাংলা সিনেমার খুঁটিনাটির দিকেও নজর দিতে ভোলেননি ফাদার দ্যতিয়েন।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াতেন। উত্তর কলকাতার তেলিপাড়া লেন থেকে পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা পরে ঘুরে বেড়াতেন সাইকেলে। ১৯৫১ সালে সেন্ট জেভিয়ার্সের রেক্টর ফাদার হেনরি বারকে অনুরোধ করেছিলেন তাকে কোনও গ্রামে পাঠাতে। যাতে ঝরঝরে মুখের বাংলা আয়ত্ত করতে পারেন। সুন্দরবনের নানা গ্রামে এরপর ঘুরে বেড়িয়েছেন দ্যতিয়েন। বাংলাভাষাকে শিকড় থেকে চিনেছেন।
নেহাত বাংলা লেখা নয়, বাংলা পত্রিকা সম্পাদনাও করেছিলেন ভিনদেশি বাঙালি এই মানুষটি। হিন্দি শিখতে শিখতে মাঝপথে ছেড়ে দেন- পাছে বাংলা ভাষা থেকে দূরে চলে যেতে হয়, এই ভয়ে।
ভারতে থাকাকালীন তিনি বহু উন্নত সাহিত্যকীর্তির ছাপ রাখেন। তাঁর বিভিন্ন রচনায়, প্রবন্ধে তিনি অনবদ্য রসবোধের পরিচয় রেখেছিলেন। ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’ গ্রন্থটির জন্যে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘নরসিংহ দাস’ পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও আটপৌরে দিনপঞ্জী, রোজনামচা, তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
তিনি একজন সুঅনুবাদক হিসেবেও ছাপ রেখে গিয়েছেন। বাংলা এবং ফরাসি ভাষায় তার বেশ কয়েকটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির তরফ থেকে রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কারে তাকে পুরস্কৃত করা হয় ২০১০ সালে।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
পল দ্যতিয়েন ১৯২৪ সালের আজকের দিনে (৩০ ডিসেম্বর) বেলজিয়ামের রশফর শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
লেখক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব